আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “ধান বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
ধান
ভূমিকা
জীবনধারণের জন্যে মানুষ একদিন কৃষির সূচনা করেছিল। সভ্যতার ক্রমবিকাশে কৃষির আবিষ্কার নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন । সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের কৃষিজাত ফসলগুলোর মধ্যে ধান প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এ দেশের সব এলাকাতেই কমবেশি ধান উৎপন্ন হয়ে থাকে। কৃষিজাত ফসল হিসেবে ধানের উৎপাদন ও চাহিদা কেবল বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষেরই প্রধান খাদ্যশস্য ধান।
বর্ণনা
ধান গাছ এক প্রকার তৃণজাতীয় উদ্ভিদ। এটি সাধারণত দু’ থেকে তিন হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো ধান গাছ পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ধিত হয়ে প্রায় দশ-বারো হাতও হয়ে থাকে। ধান ওষধি জাতীয় উদ্ভিদ। একরার ফসল উৎপন্ন করে মরে যায় । তাই প্রতি বছরই নানা মৌসুমে ধানের চাষ হয়ে থাকে ।
উৎপত্তি স্থান
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ধানের চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়। এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ধান উৎপাদনে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতে ধান উৎপন্ন হলেও বৃহত্তর বরিশাল জেলা ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। বরিশাল জেলাকে এ জন্য বাংলাদেশের শস্যাগার হিসেবে অভিহিত করা হয় ।
প্রকারভেদ
ধান নানা প্রকারের। তন্মধ্যে আমন, আউশ এবং বুরো প্রধান। এ ছাড়াও রয়েছে উন্নত জাতের ইরি ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট’ প্রায় প্রতি বছরই তাদের নিরলস গবেষণা দ্বারা উন্নত জাতের ধান আবিষ্কার করছে।
চাষপ্রণালি
ধানের উৎপাদনে নানা জাতের চাষ পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ কৃষকই ধান উৎপাদনে পুরোনো পদ্ধতিই অনুসরণ করে থাকে। শীতের শেষে ধানের জমি কর্ষণের কাজ শুরু হয়। ধানের জমি উত্তমরূপে চাষ দিয়ে ঢেলা ভেঙ্গতে মই দিতে হয় । চৈত্র-বৈশাখ মাসে দু’ এক পশলা বৃষ্টির পর পুনরায় দু’একবার চাষ দিয়ে ধানের বীজ ছিটিয়ে মই দেয়া হয়। জমিতে বীজ ছড়ানোর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মাটির অভ্যন্তর থেকে ধানের শিশুচারা বেরিয়ে আসে। ধানের চারাগুলো কিছুটা বড় হলে প্রথমবারের মতো নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। অতঃপর আগাছার পরিমাণ বোঝে পুনরায় দু’একবার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই আউশ এবং আমনের বীজ একসাথে মিশ্রিত করে বপন করা হয়। আযাঢ় মাসে আউশ ধান পাকতে শুরু করে এবং আমন ধানের চারা রেখে কেবল আউশ ধানগুলো বেছে বেছে কাটা হয়। কখনো কখনো ভাদ্রমাস পর্যন্ত আউশ ধান কাটা চলতে থাকে। বর্ষার পানিতে আমন ধানগুলো পরিপুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠে। আশ্বিনে আমন ধানের শিষ ফোটতে শুরু করে। হেমন্তে আমন ধান পেকে মাঠের পর মাঠ সোনায় সোনায় ছেয়ে যায়। শীতকালে বুরো ধানের চাষ করা হয়। বর্তমানে বুরো ধানের পাশাপাশি ইরি ধানের চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কারণ এর ফলন অন্যান্য ধানের তুলনায় অনেক বেশি। বৈশাখ মাসে বুরো ও ইরি ধান ঘরে তোলা হয়। বর্তমানে নানা জাতের ইরি ধানের উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় সারাবছরই ইরি ধান জন্মে। এ ধান উৎপাদনের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। ইরি এবং বুরো ধানের চারা প্রথমে বীজতলায় উৎপন্ন করে নিতে হয় ৷ এ চারা তিন চার ইঞ্চি লম্বা হলেই বীজতলা থেকে তা তুলে নিয়ে মূল জমিতে লাগানো হয়। ইরি ধানের ক্ষেত্রে সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করা হয়। এতে অধিক ফলন নিশ্চিত হয় ।
ধান উত্তোলন ও মাড়াই
শিষ ফোটার পর থেকে ধীরে ধীরে ধান বীজ পরিপুষ্ট হতে থাকে। একসময় তা পেকে গিয়ে সোনালি রঙ ধারণ করে। এ সময় ধান গাছের পরিপক্ক শিষগুলো কিছুটা ডাঁটাসহ কর্তন করে নেয়া হয়। পরে গরু অথবা মাড়াই যন্ত্রের দ্বারা শিষ থেকে ধানবীজগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অতঃপর ধানগুলোকে ভালো করে রোদে শুকিয়ে ডোল অথবা বৈড়িতে তুলে রাখা হয় । কখনো কখনো বস্তাবন্দি করেও রাখা হয়। অতঃপর চাহিদা মতো শুকনো ধান দু’একদিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে সিদ্ধ করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এ সিদ্ধ ও শুকানো ধান ঢেঁকি অথবা মেশিনে ছেঁটে চাল তৈরি করা হয়। ক্ষীর, পিঠা ইত্যাদি তৈরির জন্য আসিদ্ধ ধান থেকে চাল তৈরি করা হয়। এ চাল ‘আতপ চাল নামে পরিচিত।
ধানের অন্যান্য অংশ
ধান গাছ থেকে পরিপক্ক অবস্থায় ধানবীজ সংগ্রহ করা হয়। ধান গাছের কোনো অংশই ফেলনা নয়। এর প্রতিটি অংশই কোনো না কোনোভাবে নানাবিধ প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। ধান গাছের অধিকতর উৎকৃষ্ট অংশ শুকিয়ে খড় তৈরি করা হয়। এ খড় গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্য নিষ্কৃষ্ট অংশ ‘নাড়া’ নামে পরিচিতি। এগুলো জ্বালানি হিসেবে গ্রাম্য গৃহিণীদের কাছে খুবই সমাদৃত। ধানের ‘তুষ’ জ্বালানি এবং ‘কুঁড়া’ হাঁস-মুরগি ও গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভাতের ‘মাড়’ গরুর ও মহিষের উৎকৃষ্ট খাদ্য ।
আরো পড়োঃ
ধান থেকে তৈরি উপকরণ
ধান থেকে তৈরি হয় চাল । এ চাল গরম পানিতে সিদ্ধ করে ভাত রান্না করা হয়। চালের গুঁড়ি থেকে পিঠা, পায়েস, ফিরনি প্রভৃতি তৈরি করা হয়। ধান এবং ধানজাত চাল থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিড়া, মুড়ি, খৈ, মোয়া প্রভৃতি মুখরোচক খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা হয়। বাংলার ঐতিহ্যের সাথে আবহমান কাল থেকে মুড়ি, মুড়কি, পিঠা, পায়েস প্রভৃতি একাত্ম হয়ে আছে।
ধান উৎপাদনে প্রতিকূলতা
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি সাংবাৎসরিক ব্যাপার। বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে ইঁদুর, পঙ্গপাল, পোকা-মাকড় প্রভৃতির উপদ্রব। তাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিজ্ঞানসম্মত বহুমুখী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সর্বপ্রকার দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেষ্ট ও সচেতন থাকতে হবে। তবেই সোনালি ধানে ভরে ওঠবে কৃষকের গোলা ।
ধান ক্ষেতের দৃশ্য
ধান ক্ষেতের দৃশ্য অতিশয় মনোরম এবং নয়ন মুগ্ধকর। কচি ধানের ক্ষেতে বাতাসের দোলা উদ্বেল করে তোলে এক সবুজ নদী। ‘এমন ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে’— কবির এ বাণীর চিত্রকল্পে চঞ্চল হয়ে ওঠে আমাদের মন ও মানসদৃষ্টি। আশ্বিনের শিষ-ফোটা ধানের ক্ষেতে উত্তুরে হাওয়া বয়ে আনে এক নতুনের ইশারা। সোনালি ধানের হেমন্তের মাঠে কৃষকের কাস্তে ধরা হাতে আনন্দের নাচন জাগে। এ দৃশ্য পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশেই অনন্য ।
উপসংহার
আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ধানের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা, অদূরদর্শিতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ধানের উৎপাদন প্রতিনিয়তই নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্যে ধান উৎপাদনে ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগকে আরো বাস্তবমুখী ও গতিশীল হতে হবে। চাষ, সেচ, কীটনাশক, বীজ, চারা প্রভৃতির সহজলভ্যতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধান উৎপাদনে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে সোনালি ধানের নয়নমুগ্ধ সৌন্দর্যে এদেশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠকে ভরে তুলতে হবে।
আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।