নির্মিতিরচনা

রচনাঃ নৌকা ভ্রমণ

নৌকা ভ্রমণ / নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা / একটি ভ্রমণ কাহিনি

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “নৌকা ভ্রমণ / নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা / একটি ভ্রমণ কাহিনি বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

নৌকা ভ্রমণ / নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা / একটি ভ্রমণ কাহিনি

ভূমিকা 

‘ভ্রমণ’ শব্দটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে একটি আনন্দময় অনুভূতি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি বিরাট স্থান দখল করে আছে নৌযান। দৈনন্দিন প্রয়োজনে নৌকাযোগে যাতায়াত বৈচিত্র্যহীন একটি সাধারণ ঘটনা মাত্র। কিন্তু সুদীর্ঘ পথে নৌকা ভ্রমণের আনন্দটাই ভিন্ন। শ্রাবণের ভরা বর্ষা। এ সময় হঠাৎ একদিন নৌকা ভ্রমণের সুযোগ এসে গেল। আমাদের গ্রাম থেকে সোনাকান্দি অনেক দূরের পথ। আমার বড় খালার বাড়ি। সেখান থেকে খালাতো বোনের বিয়ের নিমন্ত্রণ এসেছে। নিমন্ত্রণ পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। বাড়ির সবাই মহাখুশি। 

আয়োজন 

গ্রামের নজর আলী মাঝির নৌকা ঠিক করা হলো। তিন মাল্লার ছৈওয়ালা নৌকা। সারাদিনের সুদীর্ঘ যাত্রাপথ। খুব ভোরে রওনা দিলে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা লেগে যাবে। দুপুরের খাবার নৌকায়ই খেতে হবে। তার জন্য সঙ্গে নিতে হবে চাল-ডাল তৈজসপত্র। যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক হলো। সেই সঙ্গে সমস্ত আয়োজনও সম্পন্ন হলো।

আরো পড়োঃ

যাত্রা 

খুব ভোরে আমরা ঘুম থেকে জাগলাম। বাড়ির ঘাটে এসে লেগেছে নজর মাঝির নৌকা। ঘুম ভাঙ্গা ঝাপসা চোখে নৌকা দেখে আনন্দ আর ধরে না। মনের কোণে বর্ষালী হাওয়া দোলা দিতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম নৌকা ভ্রমণের স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রাতঃকালীন প্রস্তুতি শেষে বাবার নির্দেশনায় আমরা সকলে নৌকায় গিয়ে ওঠলাম। বাবা, মা, আমার বড় বোন বেলা-সহ আমরা সবাই নৌকাযোগে সোনাকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নজর মাঝি আল্লাহ্-রসূলের নাম নিয়ে কলকল করে নৌকা চালাতে লাগলেন ।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য 

চারদিকে সকালের সোনারোদ ছড়িয়ে পড়েছে। শাপলার শুভ্র পাপড়িতে জমাট বেঁধে আছে কাঁচা রোদের ঝিলিক। নানা প্রকার জলজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ বিলের বুক। স্বচ্ছ নিটোল জল। অনেক গভীর পর্যন্ত ডুবিয়ে দেওয়া যায় দৃষ্টিকে আমাদের গ্রাম থেকে নৌকা ততক্ষণে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। মনে হলো গ্রামখানির অর্ধেকটা যেন পানির নিচে ডুবে আছে। দূরের গ্রামগুলোকে শ্যামলতায় ও সৌন্দর্যে আরো মোহনীয় মনে হলো। বিলের বুকে বিচরণশীল জলচর পাখিরা খাদ্যের অন্বেষণে ব্যস্ত। বক, ডাহুক, পানকৌড়ি, বেলেহাঁস –– বর্ষার বুকে বিস্তার করে আছে অপরূপ সৌন্দর্য। ইতোমধ্যে লোকালয় জেগে ওঠেছে। আরো অনেক নৌকা যাতায়াত করতে শুরু করেছে। আমাদের নৌকাটি বিল পাড়ি দিয়ে নতুন লোকালয়ের নিকটবর্তী হয়েছে। গ্রামের বউ-ঝিরা ঘাটে বসে থালা-বাসন মাজছে। নানা রকম গল্প করছে। ছোটো ছোটো নৌকা নিয়ে গ্রামের লোকজন এ-পাড়া ও- পাড়া যাতায়াত করছে। আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে গ্রামের খাল দিয়ে। পেছনে হাল ধরে আছেন নজর মাঝি। সামনে ছপাৎ ছপাৎ দাঁড় টেনে চলছে আর দু’জন মাল্লা। গ্রামের ঝোপে থোকা থোকা ঝুলে আছে বেতস ফল । লাল হয়ে আছে তেলাকোচা আর মাকাল ফল। পানির কিনারে আলো করে আছে সারি সারি কেতকী ফুল। গ্রামের ছোট্ট খাল সাঁতরে পার হচ্ছে নেড়ি কুকুর। রাখাল ছেলে ভেলায় ছাগল নিয়ে পার হচ্ছে। গ্রাম্য কিশোররা দুরন্ত স্রোতে সাঁতার কাটছে। জেলেরা ‘ভেসাল-জাল’ ফেলে মাছ ধরছে। অনবদ্য বর্ষার সে এক মনকাড়া দৃশ্য ৷

নদীপথ 

গ্রামের খাল-বিল পেরিয়ে এক সময় নৌকা এসে নদীতে পড়ল। খরস্রোতা দুরন্ত বংশাই নদী। নদীতে প্রবেশ মুখেই মাঝি-মাল্লারা সমস্বরে উচ্চরবে আল্লাহ্-রসুলের নাম নিলেন। ঘোলাজল, ঢেউয়ের গর্জন। নৌকা ভীষণ দুলতে লাগল। সাঁতার জানলেও বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই মাঝিরা নৌকাকে সামলে নিল। স্রোতের অনুকূলে নৌকা ভেসে চলল ৷ দাঁড় তুলে মাঝিরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। ইতোমধ্যে পালাক্রমে তামাক টেনে নিলেন। তামাক টানা শেষে একজন মাল্লা গান ধরলেন:

‘মাঝি বাইয়া যাওরে— অকূল দরিয়ার মাঝে তোমার ভাঙ্গা নাওরে।’

নদী তীরের দৃশ্য 

আকাশে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কালো মেঘের আনাগোনা। তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদীবক্ষ । দু’তীরে সবুজ শ্যামল গ্রাম। যেন শিল্পী আঁকা ছবি। মা-বাবার নিষেধ সত্ত্বেও আমি গিয়ে নৌকার ছৈয়ের ওপর বসলাম। ভাটির টানে নৌকা চলছে হেলে-দুলে। নদীর দুপাশের গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। কুমোর পাড়া, তাঁতি পাড়া, জেলে পাড়া একের পর এক কত নয়নমুগ্ধ দৃশ্য। কোথাও দেখা গেল রাক্ষসী নদী গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষের ঘর-বাড়ি। কোথাওবা ছেলে-ছোকড়ারা বালু-কাদা মেখে খেলছে নদীর তীরে। গ্রাম্য রমণীরা স্নান সেরে কলসি কাখে বাড়ি ফিরছে। প্রতিটি দৃশ্যই আবেগে এবং আনন্দে ভরপুর। কোথাও দেখা গেল ঢাকাই শাড়ি পরে আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম্য বধূকে। তখন মনের অজান্তেই উচ্চারিত হলো :

‘এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধূলি লগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী।

তীরে তমালের ঘন ছায়া

আঙ্গিনায় যে আছে অপেক্ষা করে

তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর। ‘

রান্নার আয়োজন 

নৌকার মধ্যে রান্নার আয়োজন চলতে লাগল। নৌকার পেছন দিকে মাটির চুলায় মা ও আমার বোন দুজনে মিলে রান্না শুরু করে দিলেন। পথিমধ্যে এক জেলের কাছ থেকে বাবা তাজা নলা মাছ কিনলেন। দুপুরে নৌকা এসে থামল করিমপুরের হাটে। বাবা আর আমি নৌকা থেকে নেমে গেলাম। বাবা হাট থেকে মিষ্টি ও জিলাপি কিনলেন। করিমপুরের হাটে দূরদূরান্ত থেকে হাটুরেরা এসেছে। হাট সংলগ্ন নদীতীরে অসংখ্য লোকজন আর নৌকার ভিড়। দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। নৌকায় ফিরে এসে দেখলাম মায়ের রান্না শেষ। মাঝিরা স্নান করে নিলেন। আমরা সবাই এক সঙ্গে আহারে বসলাম । পটল ভাজি, মাছ ভাজি, মুরগির মাংস, মুগের ডাল। সবকিছু অমৃত বলে মনে হলো। মাঝিরা মায়ের হাতের রান্না খেয়ে খুব প্রশংসা করতে লাগলেন । বাবা বললেন— মায়ের হাতের এমন সুস্বাদু রান্না তিনি আর কখনো খান নি। আমার আর বেলা আপার ও তা-ই মনে হলো । আহার শেষে নৌকা আবার ছেড়ে দেওয়া হলো। কিছুটা পথ চলার পর আমাদের যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে হলো । শিমুলিয়া গ্রামের কাছে এসে নৌকা একটা খালের মুখে প্রবেশ করলা।

ঝড়ের কবলে 

শিমুলিয়া গ্রাম পাড়ি দিয়ে নৌকা এসে পড়ল তেঘুরিয়া বিলে। জলভরা বিশাল তেঘুরিয়া বিল। বিলটা পাড়ি দিয়ে আর দু’একটি গ্রাম পার হলেই আমরা পৌঁছে যাবো বড় খালার বাড়ি। চলার পথের নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে হঠাৎ করে একটা নিরানন্দের ছায়া পড়ল। আকাশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঘনিয়ে ওঠলো কালো মেঘ। জোরে বাতাস বইতে শুরু করলো। বিলের নিথর বুকে হঠাৎ করে বড় বড় ঢেউ জাগলো। নৌকা ভীষণ দুলতে শুরু করলো। পাল নামিয়ে ফেলা হলো। বাতাসের সঙ্গে শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। সামাল সামাল রব তুললো মাঝিরা। আমি আর বেলা আপা ভয়ে কেঁদে ফেললাম। মা দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন। ভাবলাম আজ হয়তো সকলেরই সলিল সমাধি ঘটবে। প্রবল দমকা বর্ষণে নৌকার খোলে পানি জমতে শুরু করল। একজন মাঝি বিরামহীন পানি সেচতে লাগলেন। প্রায় আধ-ঘণ্টা অতিবাহিত হলো। তারপর ধীরে ধীরে বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ কমে আসল। আমরা সকলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ধীরে ধীরে বিলের বুক শান্ত হয়ে এলো ।

সন্ধ্যালগ্নে 

মেঘ কেটে গেল ঝড়ো-বর্ষণে। আকাশের সুনীল বুক থেকে আবার ছড়িয়ে পড়ল বৈকালি মিষ্টি রোদ। বিল পেরিয়ে আমরা আবার প্রবেশ করলাম গ্রামের ভেতর। সোনাকান্দি আর বেশি দূরে নয়। সূর্য লাল হয়ে অস্তপাটে বসল। সূর্যের লাল আভা শ্যামল-সবুজ গ্রামগুলোর সীমন্তে পরিয়ে দিল সিঁদুরের রং। বর্ষার থৈ থৈ মাঠের পানি রক্তরাগে টলমলিয়ে ওঠল। কী অপূৰ্ব চিত্ৰপট! এমন সুন্দর জীবন্ত দৃশ্য আমার এ কৈশোরিক চোখে আমি আর কখনো দেখিনি। সূর্য অন্তরালে হারিয়ে গেল। জলচর পাখিরা একসঙ্গে গান ধরে সন্ধ্যা সংগীতের মাধ্যমে সূর্যকে বিদায় জানালো। ধীরে ধীরে আঁধার ঘনিয়ে এলো। গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠলো মাটির প্রদীপ। আর সেই সঙ্গে শেষ হলো আমাদের সুদীর্ঘ নৌযাত্রা। আমরা পৌঁছে গেলাম সোনাকান্দি খালার বাড়ি। 

উপসংহার 

নৌকা ভ্রমণের এ অভিজ্ঞতাটুকু আমার জীবনের এক অনন্য সঞ্চয়। গ্রামবাংলার চিরায়ত সৌন্দর্যকে আমি নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি এ নৌকা ভ্রমণের মাধ্যমে । বর্ষার ভরা বুকে নৌকা ভ্রমণের মতো আনন্দময় আর কিছু নেই ৷

আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।

Related posts

পত্রঃ সম্প্রতি পঠিত একটি গ্রন্থ সম্পর্কে নিজস্ব মতামত জানিয়ে বন্ধুর নিকট পত্র লেখ

Swopnil

ভাবসম্প্রসারণঃ বিদ্বানের দোয়াতের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র

Swopnil

রচনাঃ বাংলাদেশের পাখি

Swopnil