নির্মিতিরচনা

রচনাঃ বই পড়ার আনন্দ

বই জ্ঞানের বাহন/জ্ঞানচর্চায় পুস্তক পাঠের ভূমিকা

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বই পড়ার আনন্দ/বই জ্ঞানের বাহন/জ্ঞানচর্চায় পুস্তক পাঠের ভূমিকা বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

বই পড়ার আনন্দ / বই জ্ঞানের বাহন / জ্ঞানচর্চায় পুস্তক পাঠের ভূমিকা

ভূমিকা 

আমাদের জীবনে আনন্দ চাই। জীবনকে শুধু অর্থহীন ভোগলিস্থায় ডুবিয়ে রাখা কিংবা যান্ত্রিক ব্যস্ততায় বিষিয়ে তোলার কোনো মানেই হয় না। সজীব-সতেজ ও উপভোগ্য জীবনের জন্য চাই আনন্দের সংস্পর্শ। আর এ আনন্দটি অবশ্যই হতে হবে নিষ্পাপ, নিষ্কাম ও নিখাদ । তবে পৃথিবীতে নিষ্পাপ আনন্দের উৎস খুবই কম। তাই আনন্দকাঙাল মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই বিপথগামী হয়ে পড়ে, নেশার জগতে ডুব দিয়ে বিকৃত আনন্দের স্বাদ নেয়। আমাদের সমাজে অবক্ষয় ও অপরাধের পেছনে আনন্দের জন্য ভুল বস্তুকে ধারণ করার কারণটাই সবচেয়ে সক্রিয়। এ অবস্থায় আমরা যদি নির্মল আনন্দের উৎস অনুসন্ধান করতে চাই তাহলে অবশ্যই সৃষ্টিশীল বইকেই খোঁজে পাবো।

মানুষের জীবনে নির্মল আনন্দের প্রয়োজনীয়তা 

আমাদের জীবনে অসংখ্য সমস্যা বিদ্যমান। প্রতি মুহূর্তে এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে সবাই ভীষণ ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। আরো আছে সম্পর্কের টানাপড়েন, পরিবেশের বিরূপতা এবং জীবনের জটিলতা। এসব কারণে মানুষের জীবন থেকে স্বস্তি হারিয়ে গেছে, নেই আনন্দের পরশ। তাছাড়া প্রতিটি মানুষের ভেতরে রয়েছে এক ধরনের আধ্যাত্মিক চেতনা যা বস্তুগত প্রাপ্তিতে পরিতৃপ্ত হতে পারে না। তাই মানুষ এমন আনন্দ কামনা করে যা পবিত্র ও নির্মল, যার সাথে জাগতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ যদি এ শুদ্ধ আনন্দের সন্ধান না পায় তাহলে তার জীবন জীর্ণতায় বাঁধা পড়ে, ডুবে যায় পঙ্কিলতায়। তাই আনন্দ মানব জীবনের সবচেয়ে বড় কাঙ্ক্ষিত বস্তু, সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ।

বই ও আনন্দ 

বই নির্বাক। তবু তার বুকেই লুকিয়ে রয়েছে আনন্দের অফুরন্ত উৎস। সৃষ্টিশীল বইয়ের প্রতিটি পাতাই যেন আনন্দের সাগর। বইয়ের পাতায় যে সাহিত্য মুদ্রিত থাকে, তার সৃষ্টি প্রেরণার মূলে রয়েছে লেখকের আনন্দসাধনা। লেখক নিজে আনন্দে ডুব দিতে সাহিত্য রচনা করেন, আবার পাঠকও আনন্দে অবগাহন করতে সাহিত্যে ডুব দেয়। মানুষের আনন্দ তৃষ্ণা নিবারণই সকল সাহিত্য সৃষ্টির মূলকথা। তাই গ্রন্থ গাঠের সাথে আনন্দের বিষয়টি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আনন্দবিহীন বই অবশ্য জগতে কম নেই। সেগুলো প্রয়োজনীয় বই, ক্লাসের বই কিংবা বাজে বইও হতে পারে ।

বই পড়ার গুরুত্ব 

জীবনে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনকে বিকশিত করতে, যুগ ও জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যোগ্য করে তুলতে চাইলে আমাদের বই পড়তেই হবে। যে অন্তরে বইয়ের স্থান নেই তাকে উজাড় গৃহের সাথে তুলনা করা হয়। 

কথায় আছে ‘Reading makes a man perfect.’ অর্থাৎ অধ্যয়ন মানুষকে পূর্ণতা দান করে। 

বাস্তবজীবনে মানুষ তার চাহিদা- মাফিক কোনোকিছুই পেতে সক্ষম হয় না। সেজন্য অপ্রাপ্তি ও অপূর্ণতার যন্ত্রণা সবসময় তার অন্তরে গুমরে ওঠে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ বই পড়ার অভ্যাস করতে পারে। শুধু তাই নয়, মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন এবং চিন্তার জড়তা উৎপাটন করতে হলে বইয়ের সহায়তা নিতে হবে। বইয়ের সহায়তা মানে বই পড়া। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা ও অমর্ত্যয় চেতনার জাগরণে বই পড়া প্রধান অবলম্বন। সেজন্য মনীষী ওমর খৈয়াম স্বর্গে যাবার কালেও সঙ্গে বই নেবার কথা বলতে দ্বিধা করেননি। কেউ যদি বলে, বই না পড়ে জীবনে জ্ঞান লাভ করবে তাহলে সে পাগল বলেই গণ্য হবে। কেউ যদি জীবনে ভালো কিছু করতে চায় এবং সুন্দর করতে চায় জীবনকে তাহলেও তাকে বইয়ের কাছেই যেতে হবে। 

প্রাবন্ধিক এয়াকুব আলী চৌধুরী বলেছেন, “সাহিত্য অমৃতায়মান শক্তির উৎস । শক্তি কল্পফলের রস।” 

এ রস দ্বারা জীবনকে সরস ও সতেজ করার জন্য অবশ্যই বই পড়তে হয় । 

বইয়ের বিচিত্র জগৎ 

বইয়ের জগৎ সমৃদ্ধ ও বিচিত্র। কতো বিচিত্র বিষয়ের বই-ই না জগতে আছে। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ভক্তি, প্রেম, কতো বিষয়ের বই পৃথিবীর গ্রন্থ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। মানুষ তার নিজের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী এ ভাণ্ডার থেকে পছন্দমাফিক বই বেছে নিতে পারে। বইয়ের পাতায় মিশেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানুষের চিন্তাজগতের অসংখ্য ধারা। এ ধারায় সিক্ত হয়ে যেকোনো ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে যেতে পারে বহু মনের মিলন মেলায়। এ জগতে ছোটোদের জন্য বই রয়েছে, বড়দের জন্যও বই রয়েছে। হালকাচটুল বই যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভাবগভীর বিষয়ের বই। কোনো বই মানুষকে পুলকিত করে, কোনোটি আবার করে বিষাদগ্রস্ত। এভাবেই বিষয় বৈচিত্র্যের অনন্যতায় বইয়ের জগৎ মানুষকে প্রতি মুহূর্তে আহ্বান

করছে।

বৃহত্তর জগতের সন্ধান লাভে বই 

মানুষ মাত্রেই কৌতূহলী। মানুষ অজানাকে জানতে চায়, অচেনাকে চিনতে চায় এবং অদেখাকে দেখতে চায় । মানুষের রহস্যসন্ধানী মন ছুটে বেড়াতে চায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে । প্রকৃতির রূপসুধা পান করে সে হতে চায় পরিতৃপ্ত । সে জন্য বহুযুগ আগেই ভ্রমণের নেশা মানুষকে পেয়ে বসেছে। কিন্তু আধুনিককালে ভ্রমণের সুযোগ কমে গেছে। ইচ্ছে করলেই মানুষ যেকোনো প্রত্যাশিত স্থানে ছুটে যেতে পারে না। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা মানুষকে প্রতি মুহূর্তে গৃহবন্দি করে রাখে। এমতাবস্থায় মানুষ বই পড়ার মাধ্যমে বৃহত্তর পরিবেশের সাথে সম্পর্ক পাততে চায়। ক্ষুদ্রের মধ্যে থেকে বৃহত্তর-এর সন্ধান দিতে বই আমাদের পথ দেখায়। 

অবরুদ্ধ পরিবেশে বসবাস করতে ক্ষুব্ধ হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইয়ের পাতাতেই শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন 

‘বিশাল বিশ্বের আয়োজন মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণে,

সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে

অক্ষয় উৎসাহে… ।”

মানুষের পরম বন্ধু বই 

মানুষের জীবনে শ্রেষ্ঠ বন্ধু বই। বই তার সহচর, অকৃত্রিম শুভার্থী। বই কখনো মানুষের সাথে প্রতারণা করে না, স্বার্থোদ্ধার শেষে পড়ে না কেটে। বই নীরব ভাষায় মানুষকে সদুপদেশ দেয়। 

চিরযৌবনা বইয়ের স্বরূপ সম্পর্কে ওমর খৈয়াম বলেছেন, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।”

যোসেফ হেল বলেছেন, 

“বই আমার প্রভু এবং আমার সহচর।” 

বস্তুত বই-এর মতো এমন নিঃস্বার্থ বন্ধু মানুষের জীবনে আর নেই ! 

চিত্তের জ্বালা জুড়াতে বই পড়া 

বই মানুষকে জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে। জীবনের নানা টানাপড়েনে মানুষ যখন বিক্ষুব্ধ ও যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ে তখন সে বইয়ের মাধ্যমে মুক্তি পেতে পারে। সেই সাথে চিত্তের প্রশান্তিতও সে খোঁজে পায়। মনের সকল দুঃখ ভুলিয়ে এক কল্পনালোকে অবগাহনের ঘোর তৈরি করে দেওয়ার মতো বই এ জগতে কম নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’, ‘চোখের বালি’, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’, তারশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘কবি’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘রাজনগর, আনেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী’, জ্যাক লন্ডনের ‘সমুদ্রের স্বাদ’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠের সময় আমাদের এক অজানিত ভাবাবহ ঘিরে ধরে। আমরা এ যাপিত জীবন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই । এভাবেই মুহূর্তের জন্য হলেও আমরা জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই ৷

বই নির্বাচনে সতর্কতা 

বই মানুষের আনন্দসঙ্গী হলেও সকল বই ঢালাওভাবে পাঠ করা যুক্তিসংগত নয়। অনেক বইয়ের বিষয়বস্তু, ভাষাকৌশল ও বিষয়বস্তু শালীনতা বিবর্জিত। অনেক বই আবার মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামীও করতে পারে। সেজন্য বই নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। অন্যথায় বই পড়ার আনন্দ তিক্ততায় পর্যবসিত হতে বাধ্য ।

উপসংহার 

পৃথিবীর মধ্যে বই পড়া একমাত্র নেশা যাতে কোনো পাপের ছোঁয়া নেই। মনীষী অ্যান্থনী ট্রালোপ বলেছেন, “পাঠের অভ্যাস হচ্ছে একমাত্র আনন্দ যার মধ্যে কোনো খাদ নেই। অন্য সকল আনন্দ যখন মিলিয়ে যায় এ আনন্দ তখনো টিকে থাকে।” আমাদের প্রত্যেককে তাই ভালো বই পড়ে জীবনের সুষম বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হতে হবে।

আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।

Related posts

পত্রঃ নিরক্ষরতা দূরীকরণের তাৎপর্য বর্ণনা করে বন্ধুর কাছে পত্র লেখ

Swopnil

অনুচ্ছেদঃ রোবট

Swopnil

অনুচ্ছেদঃ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

Swopnil