আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার/বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যা/বন্যা ও বর্ষা/বাংলাদেশের বন্যা বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার / বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যা / বন্যা ও বর্ষা / বাংলাদেশের বন্যা
ভূমিকা
নদীবহুল বাংলাদেশে বন্যা এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বর্ষাকালে নদীর উৎসমুখে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হলে অথবা অত্যধিক বরফ গলনে পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দু’কূল ভাসিয়ে যখন ব্যাপক শস্যহানি, জীবননাশ, ঘর-বাড়ি ধ্বংস ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে তখন তাকে বন্যা বলা হয় ৷
বন্যা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত : প্রফেসর চেম্বার্স-এর মতে, ‘Flood is a condition of abnormally great flow of water in the river.’
জনৈক বিশেষজ্ঞের মতে
‘Flood means a sudden rise of water level in the rivers and canals which overflow their banks.’
সময়কাল
বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষাকালে বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের অবস্থান মৌসুমি জলবায়ুর বলয়ে। মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে যখন বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি ও বরফগলা পাহাড়ি ঢল নামে তখন দু’কূল ভাসিয়ে নদ-নদী বন্যার সূচনা করে ।
বন্যার কারণ
নদীবিস্তৃত বাংলাদেশে বন্যা একটি জটিল সমস্যা। বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়। যেসব কারণে বাংলাদেশ বন্যা কবলিত হয় নিম্নে তার আলোচনা করা হলো—
অতিবৃষ্টি
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে নদী-নালা, খাল-বিলের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সমতল ভূমিতে প্রবেশ করে। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
ভূমিরূপ ও গঠন প্রকৃতি
বাংলাদেশের ভূমিরূপ ও ভূমির গঠন প্রকৃতিও বন্যার জন্যে অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা, বরেন্দ্র ও গড়াঞ্চল ছাড়া দেশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৮ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এছাড়া সমতল ভূমি অঞ্চলে ভূমির ঢাল কম হওয়ায় পানি দ্রুত সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে বর্ষা মৌসুমে বন্যা সমস্যা দেখা দেয় ।
বনজ সম্পদ হ্রাস
বাংলাদেশে অতি মাত্রায় বনজ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। বনজ সম্পদ বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সহায়তা করে। বিজ্ঞানীদের মতে— কোনো এলাকায় ঘন বনাঞ্চল থাকলে সে অঞ্চলের বৃষ্টির পানির প্রায় ৩০ ভাগ বৃক্ষরাজি কর্তৃক শোষিত হয়। নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বনাঞ্চলের উচ্ছেদে দিন দিন বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিচু ভূমি
বাংলাদেশের সিলেট, ফরিদপুর জেলার কিছু অঞ্চল সমুদ্রের পানি স্তরের সমান বা সামান্য নিচুতে অবস্থিত। ফলে বৃষ্টিপাতের দরুণ জলাবদ্ধতার কারণে নিচু ভূমিসমূহে বন্যা দেখা দেয়।
বরফগলা পানি
বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীসমূহের উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বত। এর বরফগলা পানি বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সাথে মিশে নদীর পানি বৃদ্ধি করে ফলে নিম্নাঞ্চলসমূহে বন্যার সৃষ্টি হয় ।
নদীর তলদেশ ভরাট
নানা কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় নদীসমূহের পানি ধারণ ক্ষমতা এবং পানি বহন ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢল হলে নদীর দু’কূল প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে ।
অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও সেতু কালভার্টের অভাব
বাংলাদেশে বন্যার অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা। এছাড়া পর্যাপ্ত সেতু ও কালভার্টের অভাবে বৃষ্টির পানি এক স্থান থেকে অনা স্থানে দ্রুত সরে যেতে পারে না— যা এদেশে বন্যা সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ ।
আঁকাবাঁকা নদী
আঁকাবাঁকা গতিপথ বাংলাদেশের নদ-নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
সামুদ্রিক জোয়ার
মৌসুমি বায়ুর উত্তরমুখী প্রবাহ এবং বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূল ভাগে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে একদিকে যেমন নদী বাহিত পানি সমুদ্রে প্রবেশ করতে পারে না, তেমনি সামুদ্রিক জোয়ারের সময়ও সাগরের পানি স্ফীত হয় এবং উপকূলবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
বন্যার কুফল
বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি নিয়মিত বিপর্যয়। বন্যার করাল গ্রাসে এদেশের জনজীবন, শস্য সম্পদ প্রায় প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বন্যার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয় এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। বন্যার ফলে দেশে অসংখ্য মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণনাশ ঘটে। বন্যার ফলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং কৃষিনির্ভর শিল্পসমূহের উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। বন্যার কারণে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি রোগের বিস্তার ঘটে। বন্যায় ঘর-বাড়ি ডুবে গেলে মানুষের দুঃখ- কষ্টের সীমা থাকে না ৷
বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়
বন্যা নিয়ন্ত্রণ মানে বন্যার পানি প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ। বৃষ্টিপাত অপ্রতিরোধ্য তবে বৃষ্টির পানির অত্যধিক উচ্চতা ও প্রকোপ কমানোই বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য। বন্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বিরাট বাধা। জাতিসংঘের ‘ক্রুগ মিশন’সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানী বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। কমিশনগুলোর সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে নিচের উপায়গুলো অবলম্বন করে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে ।
যেমন—
১. নদী গভীর করা
পলি জমে যেসব নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি বহন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে সেসব নদী ড্রেজারের মাধ্যমে পরিষ্কার করলে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়বে। ফলে বন্যার প্রকোপ হ্রাস পাবে।
২. খালের সংস্কার
বাংলাদেশে অসংখ্য পুরোনো খাল সংস্কারের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে। এগুলো পুনঃসংস্কার করলে পানির চলাচল বৃদ্ধি পাবে এবং বন্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হবে।
৩. খাল ও নর্দমা কাটা
স্থল ভাগ থেকে পানি অপসারিত হওয়ার জন্যে খাল ও নর্দমা, কাটা প্রয়োজন । এছাড়া পর্যাপ্ত খাল থাকলে বন্যার সময় পানি খাল ও নর্দমায় প্রবেশ করে নদীর পানির উচ্চতা কমাতে পারে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৪. বাঁধ নির্মাণ
সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে এ এলাকার ফসলকে রক্ষা করা । নদীর দু’তীরে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমেও বন্যার তীব্রতা হ্রাস করা যেতে পারে।
৫. নদীর গতিপথ পরিবর্তন
নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা। ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি প্রবাহের পথ পরিবর্তন করে মেঘনা নদীর সাথে সংযোগ করলে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও সিলেট জেলার প্রায় ৩০ লক্ষ একর জমি বন্যার কবল মুক্ত হবে ।
৬. রাস্তা-ঘাট নির্মাণে সাবধানতা
বন্যা নিয়ন্ত্রণে রাস্তা-ঘাট নির্মাণে সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। বৃষ্টি এবং নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ যাতে বিঘ্নিত না হয় সে দিকে লক্ষ রেখে সড়ক, রেলপথ, বাঁধ, কালভার্ট প্রভৃতি নির্মাণ করতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে রাস্তা-ঘাট নির্মাণের মাধ্যমে বন্যার প্রকোপ হ্রাস করা যেতে পারে।
৭. যৌথ প্রচেষ্টা
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর উৎসমুখ ভারতে। বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ভারত ও নেপালের সহযোগিতা প্রয়োজন । যৌথ পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু পানিবণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব । বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যা : বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। তন্মধ্যে অর্থের সংকটই প্রধান বলে বিবেচ্য। এছাড়া রয়েছে নরম মৃত্তিকার আধিক্য, প্রচুর নিম্নভূমি অঞ্চল, নদীর পানি ধারণ ক্ষমতার হ্রাস, অত্যধিক নদ-নদী, বনভূমির স্বল্পতা, ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদি ।
অতীতের বন্যা
বন্যা বাংলাদেশের এক বাৎসরিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৬৪, ১৯৭০ সালের বন্যা এখনো মানুষের মনে আতঙ্করূপে বিরাজ করছে। ১৯৮৮ সালের নজিরবিহীন বন্যায় লাখো লাখো লোক জলবন্দি হয়ে সহায়-সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। ১৯৮৮ সালে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়।
১৯৯৮ সালের বন্যা
১৯৯৮ সালের বন্যা স্মরণকালের মহাপ্লাবণরূপে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। ‘৯৮-র বন্যার দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। মানুষের সীমাহীন দুঃখ, দুর্ভোগ- প্রাণহানি, গবাদিপশুর মৃত্যু, ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি সব মিলিয়ে ‘৯৮-র বন্যা এক মহাদুর্যোগরূপে আবির্ভূত হয়েছিল।
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বন্যা অন্যতম প্রধান বাধা। প্রতি বছর বন্যার আক্রমণ এদেশের কৃষি উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের বিপুল জনজীবনের নির্বিঘ্নিতা ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। বন্যা নিয়ন্ত্রিত হলে এদেশের জনজীবন যেমন নিরুদ্বিগ্ন তেমনি দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধি অর্জন করবে।
আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।