,

রচনাঃ বাংলাদেশের কুটির শিল্প

Posted by

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বাংলাদেশের কুটির শিল্প“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

বাংলাদেশের কুটির শিল্প

ভূমিকা

কুটিরশিল্প বাংলার হারিয়ে যাওয়া গৌরব ও ঐতিহ্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। শিল্পায়নের উন্নতির আগে কুটিরশিল্প বাংলার অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের চাহিদা পূরণ করত। বিশ্বজোড়া স্বনামধন্য ছিল ঢাকাই- মসলিন, নকশিকাঁথা ও মৃৎশিল্প। কালের স্রোতে আমাদের অতীত ঐতিহ্য আজ বিলীন। পূর্ব বাংলার অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই কুটিরশিল্প বর্তমান নবীনদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। পরম্পরাক্রমে চলে আসা কুটিরশিল্পীরা হতোদ্যম, চিন্তিত এই শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে।

কুটিরশিল্প কী ?

সাধারণভাবে ১০ জনের কম শ্রমিক নিয়ে গঠিত শিল্পগুলো কুটির শিল্পে আওতায় পড়ে। তাঁরা নিজেরা কাজ করেন আবার নিজেরাই মালিক। পরিবারভিত্তিক বা পরিবারের ক্ষুদ্র পরিসরে স্বল্প মূলধন ও সম্পূর্ণ হাতের কাজ দিয়ে চালিত শিল্পই হচ্ছে কুটিরশিল্প। কুটিরের মধ্যেই এ শিল্প উৎপাদিত হতো বলে এর নাম কুটিরশিল্প। স্থানীয় সহজলভ্য কাঁচামাল ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত দক্ষ কারিগরের শৈল্পিক ছোঁয়ায় তৈরি হয় কুটিরশিল্পজাত পণ্য। বড়ো যন্ত্রপাতি নয়, এ শিল্পের জন্য ব্যবহার করা হয় হস্তচালিত যন্ত্রপাতি।

কুটিরশিল্পের ধরন ও নাম

বাংলার ঐতিহ্য এই কুটিরশিল্পে শিল্পীর নানা ধরনের শৈল্পিক প্রতিভার ছোঁয়া পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০১১ সালের এক জরিপে বলা হয় সারা দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৮ লাখ ৩০ হাজার। আর বিসিকের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রয়েছে এক লাখ। দেশের উল্লেখযোগ্য কুটিরশিল্পগুলো হলো— তাঁতবস্ত্র, কাষ্ঠ শিল্পজাত দ্রব্য, বাঁশ ও বেতের কাজ, বোতাম, টুপি, মাটির পুতুল, বাসনকোসন, চিরুনি, পাখা, দা, পিতল-কাঁসার জিনিস, ঝিনুকশিল্প ইত্যাদি। আরও আছে শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, চাদর, শিকা, ফুলদানি ইত্যাদি। দেশ-বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শিল্প আজ অনেক পিছিয়ে পড়েছে।

কুটিরশিল্পের অতীত অবস্থা

বাংলার কুটিরশিল্প একসময় সারা পৃথিবীতে সমাদৃত ছিল। তখন বাংলার প্রতিটি গ্রাম ছিল অর্থনীতির দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ । কৃষি ও কুটিরশিল্প ছিল বাংলার অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এ দেশে নানা ধরনের কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য তৈরি হতো। তাঁতিরা বুনত চাদর, গামছা, কাপড়, কুমাররা মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলস তৈরি করত, কাঁসারিরা গড়ত কাঁসার গ্লাস-থালা। শাঁখারিরা বানাত শাঁখের দ্রব্য। দেশে এবং দেশের বাইরে এগুলো বিক্রি হতো চড়া দামে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো এই কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য। বাংলার ঢাকাই মসলিন দেশ-বিদেশের রাজদরবারে সমাদৃত ছিল। 

এ প্রসঙ্গে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন— 

“বাংলার মসলিন/বাগদাদ রোম চীন/কাঞ্চন ভৌলেই/কিনতেন একদিন।’

আজ এগুলো কেবল স্মৃতি। শিল্পায়নের ফলে ভারী যন্ত্রের ব্যবহার কারখানাজাত পণ্যের ভিড়ে কুটিরশিল্প হারিয়ে যায় কালের অতল গহ্বরে ।

কুটিরশিল্পের বর্তমান অবস্থান

বর্তমানে কুটিরশিল্পের উৎপাদন খুব সামান্যই দেখা যায়। টাঙ্গাইল, পাবনা ও ঢাকায় এখনো তাঁতের বুননে কাপড় উৎপাদন করতে দেখা যায়। কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামে বাঁশ ও বেতের শিল্প লক্ষণীয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুমারদের তৈরি মৃৎশিল্পও চোখে পড়ে ।

কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । হস্তশিল্পজাত দ্রব্যই পারে বিদেশি পণ্যের আমদানি কমিয়ে দেশে স্বনির্ভরতা ফিরিয়ে আনতে। এ শিল্পের ব্যবহার ও প্রচলন আবার শুরু হলে দেশে বেকারত্ব কমবে এবং স্বল্পশিক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। জাপানের শ্রমশক্তির ৩০ ভাগ এই শিল্পে নিয়োজিত এবং ৬০ ভাগ রপ্তানি আয়ের উৎস এই কুটিরশিল্প। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও কুটিরশিল্প যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যায় ।

কুটিরশিল্পের অবনতি ও পতনের কারণসমূহ

বিদেশি বণিকদের বাংলায় আগমন ও দেশে বৈদেশিক পণ্যের প্রচলনের ফলে কুটিরশিল্প ও কারখানাজাত শিল্পের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিদেশি কাপড়ের বাজার তৈরি করার জন্য বিদেশি বণিকরা এ দেশে রপ্তানি পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক বসায়। নিচে কুটিরশিল্পের পতনের কিছু সম্ভাব্য কারণ দেওয়া হলো-

ক. কলকারখানায় কম সময়ে অধিক দ্রব্য উৎপাদন করা যায় এবং উৎপাদন ব্যয় কম পড়ে। দাম কম হওয়ায় ভোক্তারা কারখানাজাত পণ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

খ. কারখানার তৈরি সব পণ্যের আকৃতি সমান হয় যা কুটিরশিল্পের সব ক্ষেত্রে হয় না।

গ. কুটিরশিল্পীদের মূলধনজাতীয় অভাবের কারণে কুটিরশিল্পীরা তাদের পণ্য তৈরি করতে পারে না।

ঘ. বাজারজাতকরণের সমস্যার কারণেও জটিলতা দেখা দেয় ।

ঙ. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শিল্প ঝরে পড়ছে।

কুটিরশিল্প পুনরুদ্ধারের উপায় ও উদ্যোগ

 দেশের বর্তমান অর্থনীতিতে পুনরায় কুটিরশিল্পকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কুটিরশিল্পের বাজার তৈরি করতে সহজ শর্তে মূলধন প্রদান, দক্ষ কারিগরদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জনগণকে এ পণ্য ব্যবহারে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে কুটিরশিল্পকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে ।

উপসংহার

 বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কুটিরশিল্প এক গৌরব ও সমৃদ্ধির নাম। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতায় আজ এই শিল্প বিপন্নপ্রায়। দেশের বেকারত্ব দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এ শিল্প এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে । সরকারি ও বেসরকারি যৌথ পদক্ষেপের মাধ্যমে কুটিরশিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলার গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মুখে দারিদ্র্যের রেখা সরিয়ে সমৃদ্ধির হাসি ফোটাতে পারে এই কুটিরশিল্প।

আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *