রচনানির্মিতি

রচনাঃ বাংলাদেশের কৃষক

বাংলাদেশের কৃষক / বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বাংলাদেশের কৃষক / বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

বাংলাদেশের কৃষক / বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

ভূমিকা 

পৃথিবীতে কৃষির আদি বিকাশ কেন্দ্রগুলোর একটি ‘বাংলাদেশ’। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ দেশ প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে চিরদিনই উর্বরতায় পরিপূর্ণ। কোটি কোটি কৃষকের শ্রমে-ঘামে যুগ যুগ ধরে শস্যে-সবুজে পরিবৃত হয়ে আছে এদেশের বিস্তীর্ণ ভূমি। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা আটাত্তর জন লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে এদেশের অর্থনীতি। কৃষিই বাংলাদেশের জনজীবনের সুখ-সমৃদ্ধির প্রধান অবলম্বন। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি ও অবনতির ওপর যুগপৎ জড়িত এদেশের কোটি কোটি মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও দারিদ্র্য। তাই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কবির কণ্ঠেও শোনা যায় তারই প্রতিধ্বনি—

“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।”

কৃষকের অতীত আবস্থা 

বাংলাদেশের কৃষকের অতীত ছিল সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা। ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু- এ প্রবাদই বহন করে এদেশের কৃষকের সুখকর অতীত। ইংরেজ রাজত্বের ভিত্তি তখনো স্থাপিত হয়নি। পাশ্চত্যের শিক্ষা বিপ্লবের ঢেউ তখনও এদেশের সমাজ সৈকতে আছড়ে পড়েনি। কৃষকরাই ছিল এ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তখন জনসংখ্যা ছিল কম, মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল বেশি। জমির উর্বরতা শক্তি ছিল প্রবল। কৃষকের জীবন ছিল প্রাচুর্যে ভরপুর। পিঠা-পায়েস আর নবান্নের উৎসবে মুখর থাকতো সকলের গৃহকোণ। কৃষিকর্মের পাশাপাশি কুটির-শিল্পজাত পণ্য তৈরিতেও অনেক কৃষকের সম্পৃক্ততা ছিল। ফলে অতীতে কৃষকের ঘর ছিল সুখ আর শান্তির ছায়ানীড়।

See also  রচনাঃ বাংলাদেশের খেলাধুলা

কৃষকের বর্তমান অবস্থা 

বাংলাদেশের কৃষক সমাজ তাদের অতীত গৌরব হারিয়ে বর্তমান চরম শোচনীয় অবস্থায় দিন যাপন করছে। ইংরেজ আমলে এদেশের কৃষকের যে দুরবস্থার সূচনা হয়েছিল তা থেকে আজো তারা মুক্তি পায়নি। গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিপর্যস্ত। শহর হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। বিদেশি পণ্যের আবির্ভাবে কুটির শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ‘গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গরু’-সবই এখন ধূসর স্মৃতি। দুঃখ-দৈন্য, রোগ-শোক তাদের নিত্যসঙ্গী। জনসংখ্যার বিস্ফোরণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে গিয়ে কৃষকের অবস্থা প্রতিনিয়তই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

দুরবস্থার কারণ 

পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেলেও দেশের কৃষক সমাজ এখানো আকড়ে ধড়ে আছে পুরোনো পদ্ধতির চাষাবাদ অস্থি চর্মসার একজোড়া হালের গরু আর কাঠের একটি লাঙ্গলই এদেশের কৃষকদের একমাত্র সম্বল। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ উন্নত দেশসমূহে কৃষকের শক্তি ও উৎপাদনকে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু এদেশে মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ পদ্ধতি এখনো বর্তমান রয়েছে। ফলে অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা কৃষক সমাজের ভাগ্যোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় প্রতি বছর ব্যাপক শস্যহানি ঘটে। ফলে কৃষকের ভাগ্য আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অশিক্ষা বাংলাদেশের কৃষক সমাজের পশ্চাৎপদতার আর একটি মূল কারণ। অশিক্ষার ফলে তারা চাষাবাদের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণই অজ্ঞ। শস্যপর্যায়, উন্নত বীজের ব্যবহার, সার প্রয়োগ, সেচপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়গুলো তাদের কাছে অস্পষ্ট। মহাজনের ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছে অগণিত কৃষক। মূলধনের অভাব তাদের দুরবস্থাকে আরো ত্বরান্বিত করছে। মূলধনের অভাবে কৃষি কাজে ব্যবহারযোগ্য উন্নত যন্ত্রপাতি, উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ প্রভৃতি ভারা ক্রয় করতে ব্যর্থ। কৃষিঋণ সমস্যা নিরসনে প্রচলিত থাকলেও সেখানে রয়েছে অপ্রতুলতা, অব্যবস্থাপনা এবং টাউট-দালালদের দৌরাত্ম্য । ফলে কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এ দেশের কৃষক কঙ্কাল সর্বস্ব। এদেশের কৃষক মানেই ঋণগ্রস্ত, রোগ- জর্জর জীর্ণকুঁড়ের এক চিরায়ত প্রতিনিধি। 

কৃষকের দুরবস্থা দেখে কবি নজরুল ইসলাম দুঃখ করে বলেছেন –

‘চাষীরে তোর মুখের হাসি কই?

তোর গো-রাখা রাখালের হাতে বাঁশের বাঁশি কই?’

দুরবস্থা নিরসনের উপায়

সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত এদেশের কৃষক সমাজ। আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে এবং কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন করতে প্রয়োজন কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন। এজন্যে প্রথমেই পরিহার করা প্রয়োজন প্রাচীন আমলের চাষাবাদ পদ্ধতি। সেক্ষেত্রে অবলম্বন করতে হবে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, জমি-জোত একত্র করে যৌথ খামারের মাধ্যমে অধিক ফলন নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক কৃষিপদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্যে কৃষকদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং সেই সাথে তাদেরকে কৃষি বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষক সমাজ শিক্ষিত না হলে আধুনিক চাষাবাদ, সমবায়, কৃষি ঋণ কোনো প্রয়াসই ফলপ্রসূ হবে না। কৃষকদের দারিদ্র্য মুক্তির জন্যে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বল্প মূল্যে দীর্ঘমেয়াদী কৃষি ঋণ ব্যবস্থা চালু করে মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদেরকে রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার সুদৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার হাত থেকে জমিকে রক্ষা করতে বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্যে খাল ও নদী খননের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে জলসেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক সমাজকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের সন্তান-সন্তুতিদের শিক্ষিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুষ্টি এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতিও কৃষকদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। তবেই আমাদের কৃষক সমাজ তাদের দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হবে।

See also  অনুচ্ছেদঃ ডাকপিয়ন

গৃহীত পদক্ষেপ 

কৃষি আমাদের জাতীয় উন্নতির চাবিকাঠি, আমাদের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস। কৃষকের উৎপাদিত সম্পদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে এদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। কৃষকই আমাদের খাদ্যের সংস্থানকারী, কলকারখানার কাঁচামাল সরবরাহকারী। রপ্তানি বাণিজ্যে এবং শিল্পোন্নয়নের সহায়ক শক্তি। পরাধীন আমলে এ দেশের কৃষকসমাজ ছিল কেবল চাষের মালিক, গ্রাসের মালিক তারা নয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশ ও জাতির কাছে কৃষক সমাজ আবার নতুনভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে। কৃষি-ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কৃষকের কল্যাণে সরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কৃষকের জন্যে সহজ শর্তে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরা উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ, কীটনাশকের ব্যবহার প্রভৃতি সম্পর্কে কৃষকদেরকে পরামর্শ দান করছেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যার সুফল এদেশের কৃষক সমাজ ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করছে। দু’হাজার সাল নাগাদ সবার জন্যে শিক্ষা কার্যক্রম এ দেশের কৃষকসমাজের ভাগ্যোন্নায়নের আর এক যুগান্তকরী পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হলে এদেশের অবহেলিত কৃষকসমাজ আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হবে’।

উপসংহার 

কৃষি আমাদের জীবন ধারণের প্রধান অবলম্বন। দেশগঠনে, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে কৃষকের অবদান তুলনাহীন। কৃষককে আমরা যতই অবহেলার চোখে দেখি না কেন, শিক্ষিত সমাজের আধুনিক চাকচিক্যময় জীবনযাত্রার নেপথ্যে রয়েছে কৃষকের ঘাম ঝরা সুকঠিন শ্রম। এদেশের কৃষকসমাজ এখানো দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে পর্যুদস্ত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষকের দুঃখ-নিরসনে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে কৃষকের সমৃদ্ধি জাতির সমৃদ্ধি। কৃষকই বাঙালি জাতির আশা-ভরসার চিরন্তন প্রতীক। মনে রাখতে হবে ‘কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে এবং কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’

Related posts

সারমর্মঃ বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা

Swopnil

ভাবসম্প্রসারণঃ সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত

Swopnil

অনুচ্ছেদঃ আমার পরিবার

Swopnil

Leave a Comment