রচনানির্মিতি

রচনাঃ পাট

পাট

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “পাট বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

পাট

ভূমিকা

পাট বাংলাদেশের অন্যতম কৃষিজাত অর্থকরী ফসল। প্রতি বছর পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। আমাদের দেশের কৃষকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাটের যোগসূত্র খুবই ঘনিষ্ঠ। পাটের আঁশের মূল্য ছিল সোনার মতো দামি-তাই পাটের অপর নাম ‘স্বর্ণসূত্র’ বা ‘সোনালি আঁশ’ ।

বর্ণনা

পাট গাছ এক প্রকার উদ্ভিদ। দেখতে লম্বা এবং সরু। উচ্চতা সাধারণত চার থেকে সাত-আট হাত পর্যন্ত এবং মোটা এক থেকে দু’ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাট গাছে শাখা-প্রশাখা খুব কমই দেখা যায়। এ গাছের কাণ্ডে প্রায় পুরোটাই পাতাবিহীন । মাথার দিকে কিছুটা অংশে সবুজ পাতা বিন্যস্ত থাকে। পাট গাছের রং সাধারণত সবুজ। তবে লাল জাতের পাট গাছও রয়েছে।

প্রকারভেদ

প্রজাতি ভেদে পাট নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। আমাদের দেশে সূতি, বগী, মেস্তা-এ তিন জাতের পাট উৎপন্ন হয়।

উৎপাদন স্থান

মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত বাংলাদেশের উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ু পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি স্থানে পাট উৎপন্ন হয়। মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, মিসর, আমেরিকা প্রভৃতি দেশেও কিছু কিছু পাটের চাষ হয়ে থাকে। তবে উন্নত মানের পাট চাষের জন্য বাংলাদেশ পৃথিবী বিখ্যাত ।

বাংলাদেশের পাট-অঞ্চল

বাংলাদেশের জলবায়ু এবং ভূমির প্রকৃতি পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই পাট জন্মে। তন্মধ্যে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর অঞ্চলে পাট বেশি উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাট খুব বেশি জন্মে। বাংলাদেশের প্রায় ষাট লক্ষ বিঘা জমিতে পাট চাষ হয়ে থাকে। বর্তমানে পাটের বাজার মন্দা বিধায় পাট উৎপাদনে চাষিদের উৎসাহের কিছুটা ভাঁটা পড়েছে ।

See also  ভাবসম্প্রসারণঃ যেমন কর্ম তেমন ফল

পাটের চাষ পদ্ধতি

ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পাটের বীজ বপন করতে হয়। দো-আঁশ জমিতে পাট খুব ভালো জন্মে। পাট চাষের জন্য নির্বাচিত জমিকে প্রথমে ভালোভাবে চাষ করে ঢেলা ভেঙ্গে নিতে হয় এবং মই দিতে হয়। জমি প্রস্তুত শেষ হলে পাটবীজ ছড়িয়ে পুনরায় আরো কয়েকটি চাষ দিতে হয়। অতঃপর মই দিয়ে পাটবীজকে মাটির নিচে ঢেকে দিতে হয়। বীজ বপনের কয়েক দিনের মধ্যেই বীজ থেকে চারা বের হয়। পাটের চারা একটু বড় হলে জমির আগাছা মেড়ে দিতে হয় এবং চারা গাছের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে কিছু চারা তুলে ফেলে দিতে হয়। এতে রক্ষিত চারাগুলো পরিপুষ্ট হয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। পাটের চারা দেড় দু’ফুট লম্বা হওয়ার পর পুনরায় আরেকটি নিড়ানি দিতে হয় এবং ঘন গাছগুলোকে উৎপাটন করতে হয়। পাট গাছ চার-পাঁচ হাত লম্বা হলে উৎকৃষ্ট গাছগুলো রেখে বাকি গাছগুলো বাছ দিয়ে কেটে ফেলতে হয়। এ পাটগুলো থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। একে সাধারণত বাছ-পাট বলা হয়। বপনের পর পাটগাছ পরিপুষ্ট হতে প্রায় চার-পাঁচ মাস সময় লাগে । শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাট গাছ কাটাহয়।

আঁশ সংগ্রহ

পাটগাছ কেটে প্রথমে ছোটো ছোটো আঁটি বাঁধতে হয়। অতঃপর আঁটিগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। একে ‘জাগ’ দেওয়া বলে। সপ্তাহ দু’য়ের মধ্যে সবুজ পাট গাছগুলো পচে নরম হয়ে যায়। অতঃপর পাট গাছ থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। পাটের আঁশ পাট গাছের কাণ্ডকে লম্বালম্বিভাবে বেষ্টন করে থাকে। জাগের মাধ্যমে এ আঁশ তুলে নিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হয়। ধুয়ে নেবার পর রোদে ভালোভাবে শুকাতে হয়। শুকোনো আঁশ দেখতে সাদা ও অনেকটা সোনালি হয়ে থাকে। পাটের শুকনো আঁশ বাজারজাত করা হয়। পাটগাছ থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নেওয়ার পর যে দীর্ঘ সরু কাণ্ডটি থাকে তাকে ‘পাটখড়ি’ বা ‘পাটকাঠি’ বলা হয়। জ্বালানি এবং ঘরের বেড়া ও অন্যান্য কাজে পাটকাঠি ব্যবহৃত হয়।

See also  ভাবসম্প্রসারণঃ অভাব অল্প হলে দুঃখও অল্প হয়ে থাকে

পাট ক্ষেতের দৃশ্য

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের যথার্থ রূপটি পরিস্ফুট হয় ধান-পাটের মৌসুমে। পাটের চারাগুলো যখন বড় হয়ে ওঠে তখন ঘন সবুজে ভরে ওঠে গ্রাম-বাংলার সুবিস্তৃত মাঠগুলো। পাট ক্ষেতের সবুজ-শোভা মনোরম এবং চিত্তাকর্ষক। কবির বাণীতে পাট ক্ষেতের সুবিস্তৃত সৌন্দর্য ‘সবুজ-চেলি’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। বর্ষাকালে আধ-ডুবন্ত পাট ক্ষেতের দৃশ্য আরো দৃষ্টিনন্দন ।

বাংলাদেশের পাটশিল্প

পাটের বহুমুখী ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ৭৮টি পাটকল রয়েছে। দেশের প্রধান পাটকলগুলো হলো : ‘বাওয়ানী জুট মিল্‌স’, ‘ইস্পাহানী জুট মিল্‌ল্স’, আমিন জুট মিল্‌ল্স’, ‘করিম জুট মিলস’, ‘হাফিজ জুট মিল্‌স’, ‘গুল আহমদ জুট মিলস’, ‘পিপলস্ জুটমিলস্’, ‘ক্রিসেন্ট জুটমিল্স’ প্রভৃতি। এসব জুটমিলগুলোতে পাট দিয়ে নানাপ্রকার জিনিস তৈরি হয়।

আরো পড়োঃ

পাটের প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার

পাটের প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার বহুবিধ। পাট আমাদের অনেক কাজে ব্যবহৃত হয়। পাট থেকে রশি, কাছি, বস্তা, ব্যাগ, চট, কম্বল, কার্পেটসহ নানা প্রকার জিনিস তৈরি হয়। পাটের সূক্ষ্ম ও চিকন আঁশ থেকে সুন্দর মসৃণ বস্ত্রও তৈরি হয়। বর্তমানে জুট-প্লাস্টিকের নানাপ্রকার টেকসই শিল্পদ্রব্য তৈরি হচ্ছে। রবারের সঙ্গে পাট মিশিয়ে এগুলো তৈরি করা হয় । পাট দিয়ে শিকা, ঝালর, টেবিল ম্যাট, ফুল, পাখি ইত্যাদি নানারকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীও তৈরি হচ্ছে ।

পাটখড়ির ব্যবহার

পাট গাছ থেকে তন্তু আহরণের পর যে অবশিষ্ট অংশ থাকে তা পাটখড়ি নামে পরিচিত। এ পাটখড়ি থেকে কাগজ, হার্ডবোর্ড প্রভৃতি তৈরি হয়। গ্রামেগঞ্জে পাটখড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দরিদ্র চাষিরা পাটখড়ি দিয়ে ঘরের বেড়া ঘরের চালা প্রভৃতি তৈরি করে থাকে। সম্প্রতি পাটের বীজ থেকে হৃদরোগ নিরাময়ের ওষুধ তৈরি হচ্ছে। পাট শাক এবং শুকনো পাট পাতা উপাদেয় এবং উপকারী খাদ্য হিসেবে পরিচিত।

See also  অনুচ্ছেদঃ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

পাট ও কৃত্রিম তত্ত্ব

বর্তমানে বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে পাটের বিকল্পে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার চলছে। পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিক রশি, নাইলন জাল প্রচলনের ফলে পাটের চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে পাটের উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ৩০ ভাগে নেমে এসেছে। তবে পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক রশি, নাইলন জাল প্রভৃতি কৃত্রিম তন্তুজাত সামগ্ৰী পচনশীল নয় বিধায় তা পরিবেশের ওপর নানারকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ফলে কৃত্রিম তন্তুজাত দ্রব্যের পরিবর্তে পাটজাত সামগ্রী ব্যবহারের দিকে বিশ্বব্যাপী পুনরায় একটা আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পাটের কদর আবার কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ক্ষতিকর দিক

পাট চাষের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। পাট গাছ থেকে আঁশ সংগ্রহের সময় ‘পাটের জাগ’ পুকুর, ডোবা বা বিল- ঝিলের পানি দূষিত করে। এ পাট-পচা পানি থেকে মশা জন্ম নেয়। মশার কামড়ে পল্লিবাসী ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়। পাট-পচা পানি মাছেরও ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে! অধিক মাত্রায় পাট চাষের ফলে ধানের উৎপাদন হ্রাস পায় এবং খাদ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়। ধানের দাম বেড়ে গিয়ে দরিদ্র জনগণের কষ্ট বাড়িয়ে তোলে ।

উপসংহার

পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষকের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা পাটের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক পাট চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কৃষকের উৎপাদিত পাট বিদেশে রপ্তানি করে কোটি কোটি মুদ্রা অর্জিত হলেও কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। তাই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন ।

Related posts

ভাবসম্প্রসারণঃ তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?

Swopnil

রচনাঃ ছাত্র জীবন

Swopnil

অনুচ্ছেদঃ শৃঙ্খলা

Swopnil

Leave a Comment