নির্মিতিবাংলারচনা

রচনাঃ মাদকাসক্তি ও তার কুফল

মাদকাসক্তি ও তার কুফল

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “মাদকাসক্তি ও তার কুফল/ মাদকদ্রব্য ও আমাদের যুবসমাজ বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

মাদকাসক্তি ও তার কুফল/ মাদকদ্রব্য ও আমাদের যুবসমাজ

ভূমিকা

মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বের একটি ভয়াবহ অভিশাপ। মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে চরম অধঃপতনে নিমজ্জিত হয়। জীবনে নেমে আসে হতাশা, নৈরাশ্য ও অশান্তি। ব্যক্তিজীবনের এ সর্বনাশা নেশা ধীরে ধীরে গ্রাস করে সমাজ জীবনকে । ফলে জাতির ভবিষ্যৎ ক্রমশই অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়।

মাদকাসক্তি কী ?

কোনো নেশা-জাতীয় দ্রব্য সেবন বা গ্রহণ করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়াই মাদকাসক্তি। মাদকাসক্তি এমন একটি দুর্বার নেশা যাতে একবার আসক্ত হয়ে পড়লে তা আর সহজে ত্যাগ করা যায় না। মাদকাসক্ত ব্যক্তি কীভাবে যে ধ্বংসের চোরাবালিতে আটকে পড়ে জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে তা’ সে নিজেও জানে না। মাদকাসক্তি এমন একটি অবস্থা যা সহজেই ব্যবহারকারির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর অস্বাভাবিক প্রভাব বিস্তার করে।

মাদকাসক্তির ইতিহাস

মাদকদ্রব্যের প্রতি মানুষের আসক্তির ইতিহাস সুপ্রাচীন। সুদূর অতীতকাল থেকে কোনো না কোনো সমাজে পূজা, বিবাহ, উৎসব উপলক্ষে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার প্রচলিত আছে। মাদকদ্রব্যের প্রাথমিক ব্যবহার ছিল চিকিৎসা, শারীরিক শক্তি ও মানসিক আনন্দ বৃদ্ধির জন্যে। কিন্তু বর্তমানে তা’ সর্বনাশা নেশা হিসেবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। অতীতে মাদকাসক্তি ছিল উন্নত দেশগুলোর সমস্যা কিন্তু বর্তমানে মাদকাসক্তি উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর মারাত্তক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণ, যুবক, শ্রমিক ও বেকার সমাজের এক বিরাট অংশ নেশার কবলে জড়িয়ে পড়েছে। উপরন্তু কিশোর শ্রেণিও ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। এভাবে মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বের এক ভয়াবহ সমস্যারূপে সর্বনাশ ডেকে আনছে।

মাদকদ্রব্যাদির প্রকৃতি ও উপকরণ

নেশা ক্ষণিকের জন্যে মনের যন্ত্রণা লাঘব করে নেশাকারীকে নিয়ে যায় এক স্বতন্ত্র আনন্দলোকে— এ বিশ্বাস থেকেই মাদকাসক্তির সূচনা ও বিকাশ। মদ, গাঁজা, আফিম, মরফিন, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল কোকেন, মারিজুয়ানা প্রভৃতি মাদকদ্রব্যের সর্বনাশা উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়া অনুসারে এস প্রচলিত মাদকদ্রব্যগুলোকে কয়েকটি প্রধান শ্রেণিতে সারণিবদ্ধ করা যায়। যেমন—

১. চেতনানাশক মাদকদ্রব্য : আফিম, মরফিন, হেরোইন, প্যাথেড্রিন ইত্যাদি ।

২. মনোদ্দীপক মাদকদ্রব্য : কোকেন, এমফেটামিল, ক্যাকেইন ইত্যাদি ৷

৩. অবসাদ সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য : বারবিটারেটস, মেথাকোয়ানুল ইত্যাদি ৷

৪. বিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য : গাঁজা, মারিজুয়ানা, ভাং, এল. এস. ডি ইত্যাদি ।

৫. স্নায়বিক উত্তেজনানাশক মাদকদ্রব্য : ডায়াজিপাস, নাইট্রোজিপাম, ক্লোরোডায়াজিপোক্সাইড ইত্যাদি ।

মাদকদ্রব্যের ব্যবসায়

মাদকদ্রব্যের ব্যবসা মাদকাসক্তি বিস্তারে এক মারাত্মক ভূমিকা পালন করছে। মাদকদ্রব্যের সহজ প্রাপ্যত সমাজে একদিকে যেমন নেশাকে জিইয়ে রাখছে অন্যদিকে তেমনই নতুন নেশাখোরের জন্ম দিচ্ছে। সমাজের জন্যে মাদক ব্যব মাদকাসক্তির চেয়েও অধিকতর ক্ষতিকর। বর্তমানে মাদক ব্যবসা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা লাভজনক ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এক কেজি হেরোইনের আমদানি মূল্য পাঁচ-ছয় লাখ টাকা। পক্ষান্তরে দেশের অভ্যন্তরে তার বিক্রয় মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা । সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে মাদক ব্যবসার মূল উৎপাটন আশা প্রয়োজন ।

মাদকদ্রব্যের পাচার ও সংযোগ

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা পাচ্ছে। আর এ সুযোগে চোরাচালানের মাধ্যমে জীবনঘাতী মাদকদ্রব্য আমাদের দেশেও চলে আসছে। পাকিস্তান, ভারত, ইরান আফগানিস্তান, নেপাল প্রভৃতি দেশ থেকে জল, স্থল ও আকাশ পথে মাদকদ্রব্য আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সাথে জড়িত আন্তর্জাতিক সংগঠনের নাম হচ্ছে ‘Golden Triangle’ বা ‘সোনালি ত্রিভুজ’। এর সাথে জড়িত দে তিনটি হচ্ছে থাইল্যান্ড, লাওস ও মায়ানমার। আর ‘Silver Triangle’ বা ‘রূপালি ত্রিভুজ’-এর সাথে জড়িত দেশসমূহ হচ্ছে ইরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। Golden Triangle এবং Silver Triangle মাদক চোরাচালানের জন্যে গোটা বিশ্বে কুখ্যাত ।

মাদকাসক্তির কুফল

মাদকাসক্তির কুফল অত্যন্ত মারাত্বক। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে একবার নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে তা থেকে সহজে মুক্তি লাভ করা যায় না। মাদকদ্রব্য ধীরে ধীরে দেহ ও মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন জটিল ও দুরারোগ ব্যাধিতে দেহ ও মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ব্যক্তিত্বের বিলোপ ঘটে এবং কর্মক্ষমতা লোপ পায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ বিনষ্ট করে। সমাজে দেখা দেয় চরম অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে সুস্থ সামাজিক পরিবেশকে ভয়াবহ ও জটিল করে তোলে। নেশার খরচ যোগানোর জন্যে এরা চুরি ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়। মাদকাসক্তির মারাত্নক নেশায় পড়ে অনেকে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মাদকাসক্তির কারণ

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে মাদকাসক্তি এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের সমাজে মাদকাসক্তি বিভিন্ন কারণ রয়েছে । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

১. পারিবারিক কলহ, নৈরাশ্য ও অশান্তি;

২. অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বজনিত হতাশা;

৩. মাদকাসক্ত বন্ধু-বান্ধবের সংসর্গ ও প্ররোচনা;

৪. প্রণয়ঘটিত ব্যর্থতা;

৫. মাদক ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়া;

৬. কৌতূহল ও সৌখিনতা ।

প্রতিকার

মাদকাসক্ত জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমাদের দেশের তরুণসমাজ মাদক ব্যবহারের নেশায় মারাত্নকভাবে ঝুঁকে পড়েছে। জাতিকে মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণাম থেকে রক্ষা করার জন্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা আবশ্যক ।

১. . মাদকদ্রব্যের উৎপাদন আইন দ্বারা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

২. মাদকদ্রব্যের ব্যবসায় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।

৩. মাদকদ্রব্য পাচার ও চোরাচালানী বন্ধ করা এবং এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।

৪. বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যুবসমাজ তথা অন্যান্য বেকারদের রক্ষা করা।

৫. সুন্দর, আনন্দময় ও প্রীতিপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলা।

৬. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে মাদকাসক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা

৭. মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে রেডিও, টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলোকে জনসচেতনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।

৮. আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে অপরাধ দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করা।

৯. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের চেয়ে প্রতিরোধই হলো উত্তম ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন মাদকাসক্তি প্রতিরোধের জন্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলোর কথা সুপারিশ করেছে

১. জ্ঞান-মনোভাব-আচরণ মডেল।

২. মূল্যবোধ গঠন ও পরিশোধন।

৩. মাদকের বিকল্প ব্যবহার।

৪. ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি।

৫. সম-বয়সিদের সঙ্গে শিক্ষার পরামর্শ দাতার অংশগ্রহণ।

৬. পিতামাতা কর্তৃক শিক্ষামূলক কর্মসূচি ও

৭. এলাকাভিত্তিক কর্মসূচি ।

মাদকাসক্তিজনিত সমস্যার কবলে বিশ্বের প্রায় দেশই জর্জরিত। এ সর্বনাশা নেশার কবল থেকে মুক্তির জন্যে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন একটি আন্তর্জাতিক সমন্বিত কার্যক্রম। যৌথ কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বকে মাদকমুক্ত করতে না পারলে প্রতিটি জাতির ভবিষ্যৎই অন্ধকারাচ্ছন্ন

উপসংহার

মাদকাসক্তি সমাজ জীবনের একটি নির্মম অভিশাপ। একটি সুন্দর, সুস্থ সমাজের আকাঙ্ক্ষা সকলেরই। একটি জাতির দুর্বার প্রাণশক্তি তারুণ্যের মধ্যেই সঞ্চিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, সেই সজীব শক্তির ধারক প্রাণচঞ্চল তরুণরা নেশার কবলে পড়ে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। একটি গর্বিত জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আজই প্রয়োজন মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে একটি সফল ও কার্যকর সংগ্রামে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে লিপ্ত হওয়া। নেশামুক্ত পরিবেশ গঠনে সকলের সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের উজ্জীবন প্রয়োজন।

আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।

Related posts

ভাবসম্প্রসারণঃ আলো বলে, অন্ধকার তুই বড় কালো, অন্ধকার বলে, তাই তুমি আলো

Swopnil

ভাবসম্প্রসারণঃ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন

Swopnil

পত্রঃ পরীক্ষা কেমন হয়েছে তা জানিয়ে পিতার নিকট পত্র লেখ

Swopnil