রচনানির্মিতিবাংলা

রচনাঃ শৈশব স্মৃতি

শৈশব স্মৃতি/ ফেলে আসা দিনগুলো

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “ শৈশব স্মৃতি/ ফেলে আসা দিনগুলো বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

শৈশব স্মৃতি/ ফেলে আসা দিনগুলো

ভূমিকা 

শৈশব ফেলে আসা জীবনের একফালি রঙিন অধ্যায়। স্মৃতির ঝাপি ভরা দুরন্ত গোধূলি বিকেল। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা সুখ । পুকুরের স্বচ্ছ জলে দুরন্ত সাঁতার। পাঠশালার সমস্বর নামতা পাঠ। কানামাছি, গোল্লাছুট, ডাংগুটি আর ঘুড়ি ওড়ানো বিকেল। এসব কিছু নিয়েই আমার জীবনের পটভূমিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে সোনালি শৈশব। শৈশব স্মৃতি আমাকে কখনো অশ্রুসিক্ত করে, কখনো আবার আনন্দে উদ্বেলিত করে ।

শৈশব ও প্রকৃতি 

 জীবনের সবচেয়ে দূরাগত স্মৃতির ক্যানভাস শৈশবের রং তুলিতে রঞ্জিত। তার প্রতিটি বর্ণবিভাস আমাকে প্রায়শই নিবিড়ভাবে আন্দোলিত করে। অবারিত সবুজের একটি গ্রাম আমার জন্মভূমি। শৈশবের চারণক্ষেত্র আমার গ্রাম- আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য আমি লাভ করেছি গাঁয়ের বুকে জন্ম নিয়ে। আমার জন্মভূমি, আমার প্রিয় গ্রাম আমার শৈশবের ক্রীড়াঙ্গন । জন্মভূমির সুনির্মল বাতাস আমাকে জীবন দিয়েছে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে। তারই অন্ন-জলে পুষ্ট হয়েছে আমার দেহ সবুজের বুকচেড়া মেঠোপথ, নিঃসীম আকাশ, পাখির কলকাকলি আমাকে মুগ্ধ করেছে অভিভূত ব্যঞ্জনায়। আদিগন্ত ফসলের মাঠ, ধান-কাউনের উদ্বেল মাতামাতি, পাটের চেলি, সর্ষের পরাগমাখা সুখ, খেজুরের রস, থোকা থোকা বেতস ফল আর জামরুল, বৈশাখী ঝড়ে আম কুড়ানো ধুম—এর সবকিছুই শৈশবের দিনগুলোকে ভরে রেখেছে অনবদ্য স্বপ্নে। বকের উড্ডীন পাখা থেকে ঝরে পড়া পালকের মতো জীবন থেকে শৈশব খসে পড়লেও তার স্মৃতিটুকু গেঁথে আছে জীবনের নিবিড় ঘাসে। শৈশবে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যগুলো একের পর এক এখনো আমাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। মনে হয় হাজার বছর পরেও সবকিছু যেন আমি স্পর্শ করতে সক্ষম। ঘাসের গাঢ় গন্ধ এখনো যেন জেগে আছে অধরে পাশে ।

গ্রামের পাশেই গাজীখালি নদী। দুরন্ত স্রোতধারায় মিশে আছে শৈশবের স্মৃতিময় জীবন। ছোট্ট আঁকাবাঁকা সর্পিল নদী। বুকে তার বর্ষার ঘোলা জল ঢেউ ভাঙ্গে। শীতে ক্ষীণতোয়া গাজীখালির বুকে জাগে ধূসর চর। ভিড় করে বালুচর পাখিরা। ঐ নদীর জলে স্নান করে শীতল হয়েছে আমার শৈশব। মধুমতির তীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম রং-বেরংয়ের পাল তোলা নৌকা। দূর মাঝিরা জলের বুকে ছলাৎ ছলাৎ দাড় ফেলে ভেসে যেতো ভাটির স্রোতে। মাঝিরা গুণ টেনে যেতো উজানে। সেসব স্মৃতি এখনো আমাকে নির্মল আনন্দের অধীর করে তোলে ।

See also  আমাদের জাতীয় পতাকা বাংলা রচনা (PDF)

আরো পড়োঃ

শৈশবের পাঠশালা

শৈশবের পাঠশালা জীবন অনেক স্মৃতি ও মায়ায় পরিবৃত। একখানা সবুজ সাথী বই হাতে নিয়ে ছাত্র জীবনের সূচনা। আমার পাঠশালা জীবনের প্রথম দিনটির সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে নূরুল হকের নাম। তার সঙ্গে আমি প্রথম পাঠশালায় যাই। শুরু হয় বর্ণমালার পাঠ। পাঠশালা জীবনের অনেক স্মৃতি এখনো আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। যখন আমি প্রথম শ্রেণির ছাত্র তখন আমাদের স্কুল পরিদর্শনে ঢাকা থেকে ইন্সপেক্টর সাহেব আসেন। শিক্ষকের কড়া শাসনে আমরা ক্লাসে সুবোধ-শান্তভাবে বসে পাঠাভ্যাস করছি। ইন্সপেক্টর সাহেব প্রথমে আমাদের ক্লাসে প্রবেশ করেন। ক্লাসে ঢুকে সেদিন তিনি কী বলেছিলেন তা আজ আর মনে নেই। কেবল একটি ঘটনাই মনে আছে। তিনি চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু একটা লিখে আমাদের পড়তে বললেন। আমরা সকলেই নীরব। এক সময় দুরু দুরু বক্ষে ওঠে দাঁড়ালাম। ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে ‘বোর্ডের লেখা পড়তে বললেন। গলা দিয়ে যেন কোনো কথাই বেরুতে চাচ্ছিল না। কোনো এক স্যার অভয় দিয়ে বললেন, কোনো ভয় নেই তুমি নির্ভয়ে পড়। এবার আমি বোর্ডের লেখা পড়তে শুরু করলাম। বোর্ডে লেখা হয়েছিল—’বই লও, বাড়ি যাও।’ আমার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, ‘এবার তোমরা তোমাদের বই-পত্র হাতে নাও এবং সারিবদ্ধভাবে ক্লাস থেকে বের হও এবং বাড়ি যাও।’ স্কুলে ইন্সপেক্টর আগমনের ভয়াবহ এবং কৌতুককর অনেক গল্পই পরবর্তীতে শুনেছি কিন্তু ছাত্র জীবনের প্রভাত বেলার সেই স্মৃতিটুকু আমার জীবনে এখনো অক্ষয় হয়ে আছে ।

প্রথম শ্রেণি থেকে সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠেছি। হেড স্যারের ক্লাস। তিনি আমাদের সমাজ বিজ্ঞান পড়াতেন। সেদিন কেউ-ই পড়া পারলাম না। আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে কেবল আব্দুল হাকিম পড়া শিখে এসেছিল। হেড স্যার ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তিনি হাকিমকে পাঠালেন লাইব্রেরি থেকে দশ নম্বর বেত নিয়ে আসার জন্য। আমরা সবাই কাঁদো কাঁদো। হাকিম বেত এনে হেড স্যারের হাতে দিলেন। স্যার দরজা দিয়ে বেত বাইরে ছুঁড়ে মারলেন। বললেন, ‘এ বেত কেন? দশ নম্বর বেত নিয়ে এসো।’ এবার আমরা সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। অবরুদ্ধ কান্নার চাপে গলা চেপে আসতে লাগল। হাকিম এবার মস্ত একটা মোটা বেত নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করল । বেত দেখে আমাদের অনেকের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল । স্যার গণপিটুনি শুরু করলেন। স্যার যতটা তর্জন-গর্জন করেছিলেন, দেখলাম আমাদের শিশুদের ওপর সে পরিমাণ জোরে বেত্রাঘাত করলেন না। শিশুদের সহনীয়তার মধ্যেই বেত্রদণ্ড প্রদান করলেন। তারপর থেকে আর কোনোদিন পড়া ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করিনি। পাঠশালা জীবনের সেই স্মৃতিটি মাঝে মাঝেই রোমন্থন করি।

See also  রচনাঃ আর্সেনিক দূষণ

রথের মেলার স্মৃতি

গ্রাম জীবনের মানুষের আনন্দ উপভোগের একটি অন্যতম বিনোদন স্থল মেলা। তখন আষাঢ় মাস। আমাদের গ্রাম থেকে দু’মাইল দূরে ধানকোড়া গ্রামে প্রতি বছর রথের মেলা বসে। রথযাত্রা হিন্দুদের উৎসব হলেও অন্য ধর্মের লোকেরাও রথের আয়োজনে কেনাকাটা ও আনন্দ উপভোগের জন্য মেলায় যায়। আমি অনেকবার রথের মেলায় গিয়েছি। কিন্তু শৈশবের একটি দিনের রথের মেলার স্মৃতি এখনো আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে। গ্রামের কার সঙ্গে মেলায় গিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই কিন্তু মনে আছে শুধু একটি ঘটনা। মেলায় গিয়ে দেখা হয় আমাদের ক্লাসের সহপাঠী আতাউরের সঙ্গে। আমাদের পাশের গ্রামে বাড়ি ! বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড়। সে আমাকে প্রস্তাব দিল, চল আমরা গাজীখালি স্টেশন থেকে লঞ্চে করে বাড়ি ফিরি।’ রথে গিয়েছিলাম নৌকায়। লঞ্চে বাড়ি ফেরার কথা শুনে সহজেই রাজি হয়ে গেলাম। যাদের সঙ্গে রথে গিয়েছিলাম তাদের কাউকে না বলেই আতাউরের সঙ্গে চলে গেলাম। প্রথমে আধ মাইল পথ পায়ে হেঁটে গেলাম নয়াডিঙ্গি স্টেশনে। সেখান থেকে বিআরটিসি বাসে চড়ে গেলাম গাজীখালি স্টেশনে। গাজীখালি স্টেশনে নেমে লঞ্চঘাটে গিয়ে লঞ্চের প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। লঞ্চটি আসবে ঢাকা থেকে। গাজীখালি থেকে নদীপথে আমাদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় তিন মাইল । আমাদের গ্রাম থেকে আরো এক মাইল উজানে আতাউরদের গ্রাম। লঞ্চঘাটে আতাউরদের গ্রামের পাশের গ্রামের এক শিক্ষিত দম্পতিকেও পেলাম। তারাও লঞ্চের প্রতীক্ষায় আছেন। লঞ্চ আসার সময় উত্তীর্ণ হয়ে আরো ঘণ্টাখানেক কেটে গেল কিন্তু লঞ্চ আর আসছে না। লঞ্চ না এলে কী করে বাড়ি ফিরবো চিন্তায় পড়ে গেলাম। অবশেষে আমি আমার বড় খালার বাড়ি চলে গেলাম। লঞ্চঘাট থেকে বাড়িটি দেখা যেত। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে খালার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। আমাকে একা দেখে সকলেই বিস্মিত। এ সময়ে কোত্থেকে আমি একা কীভাবে সেখানে পৌঁছলাম এটাই সকলের জিজ্ঞাসা। আমি ভয়ে এবং উৎকণ্ঠায় কেঁদে ফেললাম। তারপর সকল বৃত্তান্ত খোলে বললাম । খালু আমাদের বাড়ির অবস্থার কথা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা নিলেন। খালুর ভাতিজা তাহের ভাইয়ের সঙ্গে আমি বাড়ি রওনা হলাম । তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। আমরা পায়ে হেঁটে লঞ্চঘাটে এলাম। এসে দেখি সেই নবদম্পত্তি এবং আতাউর তখনো লঞ্চের প্রতীক্ষায় আছে। লঞ্চ না পেয়ে নৌকা ভাড়া করা হলো। সেই রাতে আমরা সকলেই একসঙ্গে নৌকাযোগে উজান নদী বেয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যখন বাড়ি পৌঁছলাম তখন হয়তো রাত দশটা বেজে গেছে। আমাকে না পেয়ে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে স্কলেই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। যাদের সঙ্গে মেলায় গিয়েছিলাম তাদের একজন বলেছিলেন যে, আতাউরের সঙ্গে আমাকে ঘুরতে দেখেছে। আতাউরদের বাড়িতে লোক পাঠানো হয়েছিল কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল আতাউরও বাড়ি ফেরেনি। তার বাবা-মাও তাকে খোঁজছেন। সেদিনের সেই বোকামির কথা স্মরণ করে আজও শিহরিত হই।

See also  রচনাঃ পহেলা বৈশাখ

উপসংহার

ইতোমধ্যে জীবনের অনেক পথ অতিক্রম করেছি। অনেক স্মৃতি ঘেরা শৈশবের যে রঙিন জীবন তাকে তো কিছুতেই ভোলা যায় না। জীবনের অমূল্য সম্পদ হয়ে স্মৃতির জানালায় বারবার উঁকি দিয়ে যায় ফেরারি শৈশব। তাকে বিস্ময়ে স্মরণ করি, তাকে অনেক গল্পে বরণ করি। কত বিচিত্র অনুভব আর ঘটনার সমারোহে সজ্জিত অফুরন্ত আনন্দের শৈশব। আমার স্মৃতিময় জীবনে শৈশবের সেই গোলাপটি আজীবন রঙিন হয়ে থাক ।

আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।

Related posts

ভাবসম্প্রসারণঃ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি

Swopnil

ভাবসম্প্রসারণঃ কেন পান্থ ক্ষান্ত হও হেরি দীর্ঘ পথ, উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?

Swopnil

আবেদন পত্রঃ ‘মশক নিধন’ অভিযান শুরু করার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন পত্র লেখ

Swopnil

Leave a Comment