নির্মিতিরচনা

রচনাঃ বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ

ভূমিকা

বাংলাদেশের শ্যামল-সবুজ পটভূমিতে বিস্তৃত হয়ে আছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-জলাশয় প্রভৃতি। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এ প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় এদেশের মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্যময় অতীতকে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, পুষ্করিণীতে আজ আর আগের মতো মাছ নেই। এর কারণ বহুবিধ। বাঙালির সহজলভ্য এ আমিষের অভাব আজ সারাদেশে। অথচ এ মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু উৎপাদনের মাধ্যমে দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় আটভাগ মৎস্যজীবী । জাতীয় অর্থনীতিতে মাছের গুরুত্ব অপরিসীম।


মৎস্য সম্পদের উৎস

বাংলাদেশে মৎস্যের উৎস নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-দিঘি, হাওর-বাঁওড়। এছাড়াও বাংলাদেশের সামুদ্রিক নোনাজলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। সুতরাং উৎসগত দিক থেকে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় । যথা : ১. অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদ ; ২. সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ।

১. অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদ

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদ স্বাদু পানির মৎস্য ক্ষেত্রে উৎপন্ন হয়। এদেশের অভ্যন্তরে জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। এছাড়া রয়েছে প্রচুর পুকুর, দিঘি, জলাশয়, হাওর-বাঁওড় প্রভৃতি। এসব জায়গায় প্রচুর মাছ উৎপন্ন হয় । বাংলাদেশের স্বাদু বা মিঠা পানিতে যে পরিমাণ মৎস্য উৎপন্ন হয় সেদিক থেকে পৃথিবীতে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাত লক্ষ মেট্রিক টন অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপন্ন হয়। এ অভ্যন্তরীণ মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, কৈ, মাগুর, শিং, চিতল, বোয়াল, পুঁটি, টেংরা, টাকি, শৈল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মৎস্যজগতে ইলিশ মাছ অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয়। বর্ষাকালে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। এ ইলিশ মাছ বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।

২. সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ

বাংলাদেশের দক্ষিণ ভাগে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান। বাংলাদেশের প্রায় ৭২৪ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূল রয়েছে এবং উপকূল বরাবর প্রায় ছয় হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে প্রচুর মাছ রয়েছে। এছাড়া পদ্মা, মেঘনা, ব্ৰহ্মপুত্ৰ প্ৰভৃতি নদীর মোহনা ও মোহনা-সংশ্লিষ্ট ব-দ্বীপগুলো মাছের উৎকৃষ্ট চারণক্ষেত্র। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল গভীরতার দিক থেকে কম বলে এখানে বিচিত্র ধরনের মাছ বিচরণ করতে পারে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— হেরিং, ক্রেকাব, গলদা চিংড়ি, স্যাকালের, হাঙ্গর, স্কেট প্রভৃতি। অগভীর সমুদ্রে কোরাল, রূপচাঁদা, ভেটকি, রিটা, পোয়া, তপসে, তালিয়া প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায় । বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল থেকে প্রতি বছর প্রচুর নোনা পানির মাছ ধরা হয়। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন সংস্থার অধীনে অর্ধ-শতাধিক ট্রলার রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে সামুদ্রিক মৎস্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ সামুদ্রিক মৎস্য বিদেশে ও রপ্তানি করা হয়।

মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লক্ষ একর এলাকায় স্বাদু পানির মাছ এবং প্রায় ৫০ লক্ষ একর এলাকায় নোনা পানির মাছ চাষ করা হয়। আমাদের জাতীয় আয়ের প্রায় ৪.৮৬% এবং রপ্তানি আয়ের ৪.৩৬% মৎস্য সম্পদ থেকে অর্জিত হয়। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩০০০ কোটি টাকা আয় করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য-সম্পদের ব্যাপক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন—

১. খাদ্য হিসেবে

মানবদেহের পুষ্টি সাধনে মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। মাছ আমিষ জাতীয় খাদ্য। বাঙালির প্রিয় খাদ্য হিসেবে মাছ প্রবাদে পরিণত হয়েছে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’—এ প্রবাদ থেকেই এদেশে মাছের প্রাচুর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

২. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে

প্রতি বছর বাংলাদেশ মাছ এবং মাছজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে। এ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এর পরিমাণ বছরে প্রায় কয়েকশ’ কোটি টাকা।

৩. পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে

মৎস্য সম্পদ কেবল মানুষের খাদ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না। পশু-পাখির খাদ্য হিসেবেও মাছের গুরুত্ব রয়েছে। মাছের পরিত্যক্ত অংশ এবং কাঁচা মাছ হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৪. শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে

শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে মাছের ব্যবহার রয়েছে। সাবান, গ্লিসারিন, চামড়া শিল্পে মাছ, মাছের আঁশ, চর্বি, তেল প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়।


৫. চিকিৎসা ক্ষেত্রে

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে প্রচুর হাঙ্গর ও নীল তিমি পাওয়া যায়। হাঙ্গর ও নীল তিমি থেকে যে তৈল পাওয়া যায় তা কলকারখানায় ও পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কডলিভার অয়েল মানুষের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয় ।


৬. কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে

বেকার সমস্যা সমাধানে ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। মৎস্য চাষ করে এবং শিকার করে অনেকে জীবিকা অর্জন করে। এতে তাদের যেমন কর্মসংস্থান হয় তেমনি জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লক্ষ লোক মৎস্য চাষ ও শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে ।


৭. আনুষঙ্গিক শিল্পের উন্নতি

  • মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে দেশে অন্যান্য শিল্পও গড়ে ওঠেছে। মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে নৌকা, লঞ্চ, ট্রলার প্রভৃতি। মৎস্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য বরফকল ও লবণ শিল্প গড়ে ওঠেছে।
  • বাংলাদেশের মৎস্য পরিস্থিতি : ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ হলেও বর্তমানে দেশে মাছের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। নদী ভরাট, পুকুর, দিঘি, হাওর-বাঁওরে পর্যাপ্ত পানি না থাকার কারণে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের কারণেও মাছের উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া যে হারে মানুষ বাড়ছে সে হারে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। একদিকে মাছের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে অন্যদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে—এ দ্বিমুখী অন্তরায়ের ফলে বাংলাদেশে মৎস্য সম্পদের সংকট দেখা গিয়েছে। সংকট উত্তরণ ও মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যৎ : বর্তমানে বাংলাদেশে মৎস্য সম্পদের যে সংকট দেখা দিয়েছে তা থেকে উদ্ধার না পেলে দেশের অর্থনীতি যেমন বিপর্যস্ত হবে তেমনি দেশবাসীর স্বাস্থ্য সমস্যা ও পুষ্টিহীনতা দেখা দেবে। তাই দেশের মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে সকলেরই যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন—
  • সুপরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে দেশের সর্বত্র মৎস্য চাষ করতে হবে।
  • দেশের হাজা-মজা পুকুর, খাল-বিল ডোবা-নালা সংস্কার করতে হবে এবং ভরাট নদীসমূহ খনন করে গভীরতা বৃদ্ধি করতেহবে।
  • উন্নতজাতের মৎস্য চাষ বৃদ্ধি করতে হবে।
  • পানির দূষণ রোধ করতে হবে।
  • মৎস্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করার সুবিধাদি বৃদ্ধি করতে হবে।
  • অপরিণত মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে ।
  • সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ।
  • দেশের সামুদ্রিক মৎস্যের বিচরণ ক্ষেত্রে বিদেশি মৎস্য-শিকারিদের প্রবেশ রোধ করতে হবে।
  • মৎস্যের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যকে চাঙ্গা ও উন্নত করতে হবে।


উপসংহার

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। নদীমাতৃক বাংলাদেশে মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যৎ খুবই সম্ভাবনাময়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে মৎস্য চাষ সম্প্রসারিত করে দেশের এ রুপালি সম্পদকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সচল করে তুলতে হবে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এ লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারে সকলের সচেতন ও যত্নবান হতে হবে ।

আরো পড়োঃ

Related posts

অনুচ্ছেদঃ রিকশাওয়ালা

Swopnil

ভাবসম্প্রসারণঃ কর্তব্যের কাছে ভাই-বন্ধু কেহই নাই

Swopnil

রচনাঃ জাতিগঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

Swopnil