নির্মিতিবাংলারচনা

রচনাঃ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ রচনা

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “আমাদের মুক্তিযুদ্ধ রচনা” এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

ভূমিকা

বাঙালি স্বাধীনতাপ্রিয় মুক্তমনা জাতি। যুগে যুগে এ জাতি সবরকম প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। কোনোভাবেই তারা অন্যের বশ্যতাকে স্বীকার করে নিতে চায়নি কখনোই। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ স্বাধীনতা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা, গৌরবময় এই মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে আপন মহিমায় ভাস্বর । 

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি

ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে এই ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হয়। এর পরপরই ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ, নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানি শাসনামলে এ দেশবাসী মোটেই স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সব ক্ষেত্রে আমাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে । নানাদিক থেকে আমরা বঞ্চিত হই । প্রথম বড়ো আঘাত আসে ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষার ওপর । পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ দেশবাসী বুকের রক্ত দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সে অপচেষ্টা প্রতিরোধ করে। কিন্তু তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় বাঙালিরা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থান আমাদের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে ৷

এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাখো জনতার উপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে [সোহরাওয়ার্দী উদ্যান] জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক এক ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫এ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই, অর্থাৎ ২৬এ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ’ থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহ

পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যাযজ্ঞের মুখে প্রতিরোধের নেশায় জ্বলে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ। শহর- গ্রামে সবখানে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ, ইপিআর, অর্থাৎ সবশ্রেণির মানুষ মিলে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। প্রথমদিকে কিছুটা বিক্ষিপ্ত ও অসংগঠিত অবস্থায় চলতে থাকে প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল এ সরকার শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্র রূপ লাভ করে । স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশাত্মবোধক গান ও অন্যান্য অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে উৎসাহ জোগায় । যুদ্ধের প্রথম চার-পাঁচ মাস মুক্তিযুদ্ধের গতিবিধি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পর ভারত সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করতে শুরু করে। এ দেশ থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়াও ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এদিকে যুদ্ধ চলাকালে এ দেশের দেশপ্রেমহীন একশ্রেণির দালাল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা শুরু করে। তারা পাকিস্তানিদের সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ঘাতক বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে মিলে দেশে গণহত্যা চালায়। ওদিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তাদের কার্যক্রম আরও জোরদার করে। তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানায় এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে । মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। যুদ্ধের শেষদিকে এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীও যোগ দেয়। পাকিস্তানিদের পরাজয় ঘনিয়ে আসে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ত্রিশ লক্ষ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে আসে বিজয়ের সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ, আমরা লাভ করি প্রিয় স্বাধীনতা ।

শত্রুর আত্মসমর্পণ

মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের অবস্থান দুর্বল হয়ে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে যায়। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

বাঙালির হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চির জাগরূক। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ থেকে দেশপ্রেমের যে চেতনা আমরা লাভ করেছি তা পরবর্তীতে সকল কাজকর্মে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। সেই একতাবোধ ও দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধের এক বিশাল প্রাপ্তি। স্বাধীনতার পর প্রায় ৪৮ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সমাজজীবনে নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে এর সুফল আমরা পাচ্ছি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে কিছু হতাশার চিত্রও রয়েছে। যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা নানা কারণেই এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তাঁদের যোগ্য সম্মান পাননি, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এ দেশে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে ৷

উপসংহার

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের বিষয়, স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ত্রিশ লক্ষ প্রাণ উৎসর্গ করে দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী চলেছে এ মুক্তিযুদ্ধ। তাই জাতীয় জীবনে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। সর্বদা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ রেখে সবাইকে ভবিষ্যতের পথে এগোতে হবে। তবেই সমুন্নত হবে স্বাধীনতা, সার্থকতা পাবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা।

Related posts

ভাবসম্প্রসারণঃ বিদ্বানের দোয়াতের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র

Swopnil

পত্রঃ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে একখানা পত্র লেখ

Swopnil

ভাবসম্প্রসারণঃ যেমন কর্ম তেমন ফল

Swopnil