আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার / মানবজীবনে পরিবেশের ভূমিকা বাংলা রচনা“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার / মানবজীবনে পরিবেশের ভূমিকা
ভূমিকা
সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানুষ কাজে লাগিয়েছে তার প্রতিভা, পরিশ্রম ও দক্ষতা। অধিগত করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন পদ্ধতি। গুহাবাসী অরণ্যচারী মানুষের জীবন আজ নানা উপকরণে সমৃদ্ধ। সে তার নিজের প্রয়োজন ও রুচির সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে আপন পরিমণ্ডল। আমাদের চারপাশের আলো-বাতাস, মাটি-পানি, নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, পশু- পাখি সবকিছু নিয়ে যে অবস্থান গড়ে ওঠেছে তা-ই পরিবেশ। পরিবেশের মধ্যেই মানুষের বিকাশ এবং বিনাশ। একটি সুস্থ সুন্দর দূষণমুক্ত পরিবেশ যেমন জীবন বিকাশের অনুকূল তেমনি একটি অসুস্থ অসুন্দর দূষণযুক্ত পরিবেশ জীবন বিনাশের সহায়ক । বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতিতে জীবনে নানাদিকে স্বাচ্ছন্দ্য আসলেও গোটা বিশ্ব-পরিবেশ আজ দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাই আজ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে ।
পরিবেশ দূষণের কারণ
পরিবেশের সাথে একটা সুচারু মিলবন্ধনের মাধ্যমে মানুষ এবং প্রাণিকুলের জীবনের বিকাশ ঘটে । প্রাণিজগৎ তার জীবনযাপনের উপকরণ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে এবং ব্যবহৃত উপকরণের পরিত্যক্ত অংশ আবার সেই পরিবেশেই ফেরত যায়। কিন্তু গ্রহণ-বর্জনের এ ভারসাম্য যখন কোনো কারণে বিনষ্ট হয়ে পড়ে তখনই সৃষ্টি হয় পরিবেশ দূষণের । প্রকৃতির বিরুদ্ধে যখন থেকে মানুষের আগ্রাসন শুরু হয়েছে তখন থেকেই সূত্রপাত ঘটেছে পরিবেশ দূষণের। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ, ভূমি, পানি ও বায়ুর ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণিজগৎ। বন উজাড় হচ্ছে, অপরিকল্পিত নগর তৈরি হচ্ছে, কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা, ত্রুটিপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত অপরিকল্পিত ব্যবহার ইত্যাদির ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে এক সংকটজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
পরিবেশ দূষণের শ্রেণিবিভাগ
পরিবেশ প্রধানত দু’ভাবে দূষিত হতে পারে। এক. প্রাকৃতিকভাবে। দুই. কৃত্রিম উপায়ে ৷ প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে সীসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। কৃত্রিম দূষণের মধ্যে রয়েছে কীটনাশক, প্রসাধন সামগ্রী, প্লাস্টিক, গুঁড়ো সাবান ইত্যাদি ।
বিভিন্ন প্রকার দূষণ ও তার প্রতিক্রিয়া :
১. বায়ু দূষণ ও প্রতিক্রিয়া
প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম সম্ভার বায়ু। কিন্তু গোটা বিশ্বজুড়ে চলছে বায়ু দূষণ। ঝুল জাতীয় কার্বন কণা থেকে শুরু করে ভারি ধাতু, জটিল জৈবযৌগ, নিউক্লিয়, আবর্জনা, জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল, কয়লা ইত্যাদি পুড়িয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাপক পরিমাণে বায়ু দূষিত হচ্ছে। ক্লোরোফ্লোরোমিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, আলোক রাসায়নিক ধোয়া প্রভৃতি বায়ু দূষণের উপকরণ। বায়ু দূষণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে নানা রকম রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, ফুসফুস ক্যান্সার প্রভৃতি বায়ু দূষণের প্রতিফল।
২. পানি দূষণ ও তার প্রতিক্রিয়া
পানি একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। পানির অপর নাম জীবন। পানি দূষণ আধুনিক সভ্যতার এক নির্মম অভিশাপ। আজ নানাভাবে সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবার পানি দূষিত হচ্ছে। কলকারখানার তরল বর্জ্য পদার্থ, শহরের নির্গম নালি বেয়ে আসা দূষিত তরল আবর্জনা নদী-নালার পানিতে মিশে পানিকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। পানি দূষণের ফলে সমুদ্র, নদী, খাল-বিল ও পুকুরের মৎস্য-সম্পদ বিভিন্ন ক্ষতরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষও নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
৩. শব্দ দূষণ ও তার প্রতিক্রিয়া
আধুনিক সভ্যতার আর এক উপদ্রব শব্দ দূষণ । শব্দ দূষণ এখন নোমাওক ব্যাপারে পারণ হয়েছে। যানবাহনের বিকট শব্দ, কলকারখানার যান্ত্রিক আওয়াজ, বাজী, পটকা, বোমা, রেডিও, টেলিভিশন, মাইকের আওয়া প্রভৃতি এক বীভৎস বিকট পরিবেশের সৃষ্টি করছে। শব্দ দূষণ অনেক ক্ষেত্রে সহনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করেছে। শব্দ দূষণে পরিণাম মোটেও সন্তোষজনক নয়। রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, স্নায়বিক দুর্বলতা, মানসিক অস্থিরতা প্রভৃতি উপসর্গগুলো দূষণেরই প্রতিফল ।
তেজস্ক্রীয় দূষণ ও তার প্রতিক্রিয়া
পারমাণবিক যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে মুক্ত পরিবেশে অতিমাত্র তেজস্ক্রীয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। গাছ-পালা ও আবহাওয়ার ওপর ক্ষতিকর প্রভা পড়ছে। হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ নানা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার ঘটছে।
বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ বিপর্যয়
গাছ-পালা ও বনভূমি কেবল প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনই করে না—মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকী মৌলিক চাহিদাও মিটিয়ে থাকে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বৃক্ষনিধন করে সেখানে তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ। বনভূমি উজাড় হচ্ছে দি দিন। ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে পড়ছে দিন দিন। অথচ সবুজ-শ্যামল বৃ ও বনভূমি দূষিত বাতাসকে শোধন করে প্রাণিকূলকে বাঁচিয়ে রাখে ।
পরিবেশ দূষণের প্রতিকার
মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সুস্থ, সুন্দর ও সুখময় জীবন নির্বাহের জন্যে প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ। পরিবেশ দূষণের ফলে ১৯৩২ ও ১৯৩৭ সালে ব্রিটেনের কতিপয় নিকেল কারখানায় ক্যান্সার দেখা দেয়। ১৯৫৩ ও ১৯৬৫ সালে জাপানে সিনাসাটী ও নিগাটা উপসাগরের পানি দূষণের ফলে মাছের মাধ্যমে স্নায়বিক রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকের মৃত্যু ঘটে। ১৯৫২ সালে লন্ডন শহরের প্রচুর লোক ধোঁয়াশাজাত রোগে আক্রান্ত হয়। এর সবই পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার প্রতিফল। ১৯৭২ সালে স্টকহামে পরিবেশ পরিশোধক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে গোটা বিশ্ব আজ সোচ্চার হয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মতে, পরিবেশ দূষণের প্রতিকারে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা আবশ্যক
– বায়ু দূষণ রোধে, কীট নিধনে জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ, রাসায়নিক পদার্থের শোধন, ধোঁয়া পরিশ্রুতিকরণ, বসতি ও শিল্পকারখানার মধ্যে উপযুক্ত দূরত্ব রক্ষা করা ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পানি দূষণ রোধে রাসায়নিক পদার্থ ও ময়লার বিশোধন করতে হবে।
– শব্দ দূষণ রোধে শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে ।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বায়ু শোধনে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
– দেশে দেশে দূষণ নিরোধক আইন চালু করতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচার মাধ্যমগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
– জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
উপসংহার
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমণ্ডলের সবকিছু নিয়ে আমাদের পরিবেশ। মানুষ ও জীবকুলের অস্তিত্বের স্বার্থে পরিবেশকে দূষণ থেকে মুক্ত রাখা প্রয়োজন। বাসযোগ্য সুন্দর একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে সকলকেই পরিবেশ সচেতন হওয়া আবশ্যক। এ পরিবেশই সাম্যের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার দায়-দায়িত্ব বহন করে থাকে ৷
আশা করি আজকের পোস্টটি তোমাদের ভালো লেগেছে। তুমি যদি অন্য কোনো রচনা চাও তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাও। ধন্যবাদ।